শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

সমরেশ বসুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল

ইমদাদুল হক মিলন

সমরেশ বসুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল

কলকাতার আনন্দবাজার গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আনন্দ পাবলিশার্স। এই প্রতিষ্ঠান থেকে আমার তিনটি বই বেরিয়েছে।

‘নূরজাহান’, ‘দেশভাগের পর,’ ‘পঞ্চাশটি গল্প’। পঞ্চাশটি গল্প নামের বইটি সমরেশ বসুকে উৎসর্গ করা। সমরেশ বসু বাংলা সাহিত্যের এক অমর লেখক। ছোটগল্প এবং উপন্যাসে তাঁর তুলনা তিনি নিজে। এই মুহূর্তে তাঁর কয়েকটি গল্পের কথা আমার মনে পড়ছে। আদব, মানুষ রতন, পাড়ি, সানা বাউরির কথকতা, অকাল বসন্ত, কে নেবে মোরে। বিষয়বিচিত্র্যে সমরেশ বসুর কোনো তুলনাই হয় না। তাঁর প্রতিটি লেখার বিষয়ই ভিন্ন। এক লেখা দ্বিতীয়বার তিনি কখনো লেখেননি। জীবিকার তাগিদে এক সময় মাথায় করে ডিম ফেরি করেছেন। পাটকলে শ্রমিকের কাজ করেছেন। রাজনীতির কারণে জেল খেটেছেন। তাঁর চেয়ে বয়সে বড় এক বিধবা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন ক্লাস টেনে পড়ার সময়। তাঁর প্রথম স্ত্রী সেই নারীর নাম গৌরি বসু। গৌরি ছিলেন বোনদের মধ্যে সবার বড়। পরবর্তীতে গৌরির সবচেয়ে ছোট সাত নম্বর বোনটিকেও বিয়ে করেন সমরেশ বসু। নৈহাটিতে বেশ বড় বাড়ি করেছিলেন শুধু লেখার টাকায়। লোকে যেমন ১০টা-৫টা অফিস করে সমরেশ বসু তেমন ১০টা-৫টা লিখতেন। থাকতেন এক ফ্ল্যাটে, লেখার জন্য অন্য আরেকটি ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছিলেন। সকাল ১০টার মধ্যে সেই ফ্ল্যাটে চলে যেতেন। বিকাল ৫টার পরে আর লিখতেন না। মেতে উঠতেন পানাহারে, আড্ডায়, গানে। সুন্দর গানের গলা ছিল তাঁর। বাঁশিও বাজাতেন খুব সুন্দর। আর দেখতে ছিলেন রাজপুত্রের মতো। এক অনুষ্ঠানে সুচিত্রা-উত্তম গিয়েছেন। পত্র-পত্রিকার ফটোগ্রাফাররা বাংলার জনপ্রিয়তম এই জুটিকে কাছে পেয়েছে। ছবি তোলার জন্য পাগল হয়ে গেছে তারা। সুচিত্রা সেন বললেন, দাঁড়ান দাঁড়ান। এখানে আমার আরেকজন নায়ক আছেন। তাঁকেও সঙ্গে রাখি। মহানায়িকা ডেকে নিলেন সমরেশ বসুকে। একপাশে উত্তমকুমার আরেকপাশে সমরেশ বসু মাঝখানে সুচিত্রা সেন। ফটোগ্রাফাররা ছবির পর ছবি তুললেন। সমরেশ বসুর কাহিনি অবলম্বনে ‘বিভাস’ নামে একটি সিনেমা হয়েছিল। নায়ক ছিলেন উত্তমকুমার। তাঁর বহু কাহিনি নিয়ে সিনেমা হয়েছে। যেমন ‘বাঘিনী’, ‘গঙ্গা’, ‘নির্জন সৈকতে’ ‘পাড়ি’ গল্প অবলম্বনে গৌতম ঘোষ তৈরি করেছিলেন নাসিরউদ্দিন শাহ এবং শাবানা আজমিকে নিয়ে ‘পার’ চলচ্চিত্রটি।

সমরেশ বসু বিক্রমপুরের লোক। রাজানগর গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকার রোকনপুরে থাকতেন কিশোর বয়সে। এই এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে ধোলাইখাল। সেই খালের চমৎকার বর্ণনা আছে তাঁর ‘কোথায় পাবো তারে’ উপন্যাসে। ‘কোথায় পাবো তারে’ তিনি লিখেছিলেন কালকূট ছদ্মনামে। দুটো ছদ্মনাম ছিল তাঁর। কালকূট এবং ভ্রমর। কালকূট নামের লেখাগুলো যেন সংসারের ভিতরে থাকা এক সন্ন্যাসী লিখে গেছেন। প্রথম লেখা ছিল ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে।’ দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছেপেছিলেন সাগরময় ঘোষ। সমরেশ বসুর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘নয়নপুরের মাটি’। সমরেশ বসুকে বলা হতো বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র। সামনের পুজোয় এই রাজপুত্র কোন বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখবেন তা দেখবার জন্য অপেক্ষা করত লক্ষ পাঠক। তাঁর প্রথমদিককার উপন্যাস ‘শ্রীমতি কাফে, বিটি রোডের ধারে, বাঘিনী, জগদ্দল, গঙ্গা। ১৯৬৫ সালে লিখলেন ‘বিবর’। তারপর ‘প্রজাপতি’। ‘প্রজাপতি’ নিষিদ্ধ হলো অশ্লীলতার দায়ে। বহু বছর মামলা চলল। বুদ্ধদেব বসু এবং নরেশ গুহ সমরেশ বসুর পক্ষে কোর্টে দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্তি পায় এই উপন্যাস। ‘বিবর’ প্রকাশের পর সন্তোষকুমার ঘোষ বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের সেরা ১০ উপন্যাসের সর্বশেষটি হচ্ছে ‘বিবর’। সমরেশ বসু নামে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পাননি তিনি। পেয়েছিলেন কালকূট ছদ্মনামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য। শাম্ব ছিলেন কৃষ্ণের ছেলে। দেশভাগের পটভূমিতে কলকাতার উদ্বাস্তু শিবির আর বিক্রমপুর অঞ্চলের বিলডিহি গ্রামের পটভূমিতে অসামান্য মায়া জাগানো এক উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। সেই উপন্যাসের নাম ‘সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা’। এই উপন্যাসটির কোনো তুলনা বাংলা সাহিত্যে নেই। মধ্যজীবনে সমরেশ বসু লিখলেন ‘টানাপোড়েন’ নামে এক উপন্যাস। বিষ্ণপুর অঞ্চলের তাঁতীদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাস দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় পড়ে আবু সায়ীদ আয়ুব এক চিঠিতে সমরেশ বসুকে লিখেছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির পর প্রকরণগত দিক দিয়ে এত সার্থক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আর নেই। নকশাল আন্দোলন নিয়ে সমরেশ বসু লিখলেন আরেক অসামান্য উপন্যাস ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’। তারপর গোপজীবন নিয়ে লিখলেন, ‘বাথান’। লিখলেন ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’। লিখলেন ‘তিনপুরুষ’। এসব উপন্যাসে তৃতীয়বারের মতো নিজের সাহিত্য কর্মের বাঁক বদল করলেন এই লেখক। তারপর শুরু করেছিলেন তাঁর সেই মহত্তম উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’। ভাস্কর রাম কিঙ্করকে নিয়ে এই উপন্যাস তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখতে লিখতেই অনন্তলোকে চলে গেলেন। টেবিলে পড়ে রইল তাঁর লেখার কাগজ-কলম আর চশমা। মৃত্যুর পর দেশ পত্রিকা তাঁকে নিয়ে যে সংখ্যাটি করেছিল সেখানে এরকম একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস সমরেশ বসুকে নিয়ে একটি শোকসভার আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, ‘সমরেশ বসু এমন এক লেখক তিনি যা লিখেছেন সেই লেখার দিকে আর কখনো ফিরে তাকাননি। তাকিয়েছেন নতুন বিষয়ের দিকে।’ সমরেশ বসুর এক ছেলে লেখক। তার নাম নবকুমার বসু। ব্যক্তিজীবনে ডাক্তার। থাকেন লন্ডনে। আমার বিশেষ বন্ধু। বাবাকে নিয়ে দীর্ঘ একটি উপন্যাস লিখেছেন নবকুমার। সেই উপন্যাসের নাম ‘পরানসখা’।

কলেজে পড়ার সময় থেকে আমি সমরেশ বসুর ভক্ত। যেখানে তাঁর যত লেখা পেতাম সংগ্রহ করে পড়তাম। স্বপ্ন ছিল যদি এই লেখককে সামনাসামনি কখনো দেখতে পাই। সেই আশা পূরণ করে দিয়েছিলেন বেলাল চৌধুরী। নব্বই দশকের শুরুর দিককার এক বিকালে বেইলি রোডের সাগর পাবলিশার্সে বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বললেন, একটা জায়গায় যাচ্ছি, যাবি নাকি আমার সঙ্গে? বেলাল চৌধুরীর সঙ্গ আমার যে কী প্রিয়, বলে বোঝানো যাবে না। জিজ্ঞেসও করলাম না, কোথায় যাবে। রিকশায় চড়ে বসলাম। ধানমন্ডির এক বাড়িতে এসে ঢুকলেন বেলাল ভাই। কলিংবেল বাজাবার পর বাড়ির লোক আমাদের নিয়ে ড্রইংরুমে বসাল। কয়েক মিনিট পর সেই রুমে এসে ঢুকলেন মাঝারি হাইটের ফুটফুটে সুন্দর, নায়কোচিত একজন মানুষ। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর খুব সুন্দর একটা চাদর। দেখতে রাজ পুরুষের মতো লাগছে। মানুষটিকে দেখে নিজের অজান্তে আমি উঠে দাঁড়ালাম। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলাম। এ আমি কাকে দেখছি? এ তো আমার সেই স্বপ্নের লেখক সমরেশ বসু! বেলাল ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন। দীর্ঘক্ষণ আড্ডা চলল। ধানমন্ডির সেই বাড়ি সমরেশ বসুর এক বন্ধুর। বন্ধুর আমন্ত্রণে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঢাকায় কয়েকটা দিন কাটাতে এসেছেন সমরেশ বসু। বেলাল ভাই তাঁর অতিপ্রিয় মানুষ। শুধু বেলাল ভাই সে কথা জানেন। সেই অবিস্মরণীয় সন্ধ্যাটি আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। সমরেশ বসুর সঙ্গে দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়েছিলাম।

সর্বশেষ খবর