শনিবার, ৯ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন কাল

আওয়ামী লীগের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ

গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

আওয়ামী লীগের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ

উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে দলের মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা। যেন আওয়ামী লীগের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে অনেক উপজেলায় বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দলীয় বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে মরণলড়াই করছেন। কোথাও স্থানীয় এমপিরা দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ভূমিকা রাখছেন, কোথাওবা কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন। দলগতভাবে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে জোর প্রচারণায় নেমেছেন। আবার যেখানে দলের বহিষ্কৃত কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেখানে তাদের পক্ষেই কাজ করছেন বিএনপি নেতারা। বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেক জায়গায় দল মনোনীত নৌকার প্রার্থী রয়েছেন ঝুঁকিতে। আগামীকাল রবিবার দেশের ৮৩ উপজেলায় প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ইসি সূত্র জানায়, আগামীকাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল  ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে। গতকাল মধ্যরাতে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়েছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণে সব প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ভোট কেন্দ্রে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী মালামাল পাঠানো হবে। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় (উপজেলা) ভোটের দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ইসি সূত্র অনুযায়ী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগের ১২ জেলার ৮৭ উপজেলায় আগামীকাল প্রথম দফা ভোট গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু তিনটি উপজেলায় চেয়ারম্যান এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত (মহিলা) ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এবং আদালতের রায়ে একটি উপজেলায় ভোট স্থগিত হওয়ায় এখন ৮৩ উপজেলায় ভোট হচ্ছে। ৮৩ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ২১৫, সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪০৬ ও সংরক্ষিত (মহিলা) ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৭৩ জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা। এতে মোট ভোটার ১ কোটি ৫২ লাখ ৭০ হাজার ৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ৫৩৪ আর নারী ভোটার ৭৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪৭১ জন। ভোট কেন্দ্র ৬ হাজার ২১৯টি। ভোটকক্ষ ৩৯ হাজার ১৫৯টি। চেয়ারম্যান পদে ১৬, সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬ ও সংরক্ষিত (মহিলা) ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সূত্রমতে, উপজেলা নির্বাচন জমজমাট করতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তৃণমূলে ছাড় দেয়। নেতাদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানে কর্মীরাও এখন দ্বিধাবিভক্ত। আওয়ামী লীগে স্থানীয়ভাবে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। বিএনপি এ নির্বাচনে আসেনি। এজন্য সারা দেশেই নৌকার প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বেশির ভাগ জায়গায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। কোথাও মনোনয়ন নিয়েই দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর বিষোদ্্গারের বাইরেও হামলা ও সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও দলীয় প্রার্থীকে এলাকায় যেতে না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। আবার বিদ্রোহী প্রার্থীকে মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করার অভিযোগও উঠেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চাই উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হোক। দলের নেতা-কর্মীরা নৌকার প্রার্থীকেই ভোট দেবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।’ তাহলে কি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই ভোট উৎসব। আশা করি সেটাই হচ্ছে।’

নৌকার প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন যারা : সিরাজগঞ্জের তাড়াশে আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিত কুমার কর্মকার। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে এখানে লড়ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. মনিরুজ্জামান ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি মীর মো. শহিদুল ইসলাম। রায়গঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইমন তালুকার ও বিদ্রোহী প্রার্থী শোভন সরকার। এখানে দুই প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। নাটোরের গুরুদাসপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি জাহেদুল ইসলাম। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। বড়াইগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক বর্তমান চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে বিদ্রোহী প্রার্থী রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদ সোহরাওয়ার্দ্দী, উলিপুরে প্রজন্ম লীগের নেতা সাজাদুর রহমান, রৌমারীতে উপজেলা বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি শেখ আবদুল্লাহ ও রাজীবপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকবর হোসেন। জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোস্তাকিম ম ল। বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তাইফুল ইসলাম তালুকদার। আক্কেলপুরে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মোখছেদ আলী মাস্টার। বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগের আবদুস সালাম আকন্দ। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন চারজন। তারা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মালেক চিশতী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান পরিমল দে সরকার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জেলা পরিষদ সদস্য হারুন উর রশিদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোখলেছুর রহমান শাহ। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বর্তমান চেয়ারম্যান হাসনাৎ জামান চৌধুরী জর্জ। নীলফামারীর ডোমারে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বসুনিয়া। জলঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আনছার আলী। বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ। সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৫০টি উপজেলায় শক্ত অবস্থানে রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। স্থানীয় এমপির সমর্থন, দলের একটি বড় অংশ সঙ্গে থাকা, বিএনপির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করার কারণে সুবিধায় আছেন।

অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হলে দায় রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার : নির্বাচনী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গতকাল মাঠে নেমেছেন পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার-ভিডিপি, কোস্টগার্ড, আর্মড পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ভোটের পরও দুই দিন মাঠে থাকবেন তারা। ভোটে অনিয়ম হলে সেই দায় রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে কমিশন। উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম ঠেকাতে ইতিমধ্যে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের তৎপর হতে নির্দেশ দিয়েছে ইসি। বৃহস্পতিবার রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদেরও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। ইসির যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। সব রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে কমিশনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কাউকে কোনো ছাড় না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এর পরও ইসির নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে এবং অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হলে দায়ভার রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারকেই নিতে হবে।’

মাঠ প্রশাসন-পুলিশকেও কঠোর নির্দেশনা : জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে ইসির নির্দেশনায় বলা হয়, যারা নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করবেন, নির্দ্বিধায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বা পরিবেশ বিনষ্টকারী যে কোনো কর্মকা- বা প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কমিশন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে কারও অবহেলা প্রত্যাশা করে না। ইসির সিদ্ধান্ত রয়েছে, নির্বাচনে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা-অনিয়ম কিংবা আইনবহির্ভূত ঘটনা ঘটলে যে কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। এ অবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে আসন্ন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে।

মাঠে থাকছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্য : ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, পঞ্চম উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচনী পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে নির্বাচনের সময় মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্য। পুলিশ, আনসার, গ্রামপুলিশ ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবে। আর স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে বিজিবি, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, আর্মড পুলিশকে মোতায়েন করা হবে। সাধারণ ভোট কেন্দ্রে বিভিন্ন বাহিনীর ১৪ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৬ জনের ফোর্স মোতায়েন থাকবে। সে হিসেবে ৬ হাজার ২১৯টি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থাকবেন ৯৩ হাজারের বেশি। আর স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে প্রতি এলাকায় দুই থেকে তিন প্লাটুন বিজিবি ও র‌্যাব এবং কোস্টগার্ড, পুলিশ, আমর্ড পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়া রিটার্নিং অফিসারের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ে তিন দিনের জন্য মনিটরিং সেল এবং নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ইসি সচিবালয়ে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।

পাঁচ দিনের জন্য মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন স্বাক্ষরিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক পরিপত্র জারি করা হয়েছে। ভোটের আগে দুই দিন, ভোটের দিন ও ভোটের পরে দুই দিন মিলিয়ে পাঁচ দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে থাকবেন।

সর্বশেষ খবর