শনিবার, ৯ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

অনলাইন মার্কেটিংয়ের আড়ালে মানি লন্ডারিং

১০ কোম্পানিকে সিআইডির তলব, নজরদারিতে আরও ১২ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান

সাখাওয়াত কাওসার

ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন মার্কেটিংয়ের আড়ালে চলছে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার)। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে পাচার করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে এসব অভিযোগের তদন্তে নেমে ইতিমধ্যে ১০টি অনলাইন মার্কেটিং কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে সত্যতাও পেয়েছে সিআইডি। এরই অংশ হিসেবে সিআইডির তরফ থেকে চিঠি দিয়ে ডাকা হয়েছিল ১০টি কোম্পানির কর্ণধারদের। দ্রুততর সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলোর লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্যাদি সিআইডি দফতরে দাখিলের নির্দেশও দিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে অনলাইনভিত্তিক ১০টি কোম্পানি ছাড়াও আরও ১২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে সিআইডি। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি টেলিকম কোম্পানিও। গত বছর ৬ এপ্রিল হাই কোর্টের ছয় আইনজীবীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চ ওই বছরের ১৮ এপ্রিল সার্চ ইঞ্জিন নামে পরিচিত গুগল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ ইন্টারনেটভিত্তিক সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্ত করে যথাযথ প্রতিবেদন দাখিল না করায় ৭ ফেব্রুয়ারি অসন্তোষ প্রকাশ করে হাই কোর্ট। একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আজ ৭ মার্চ পরবর্তী দিন নির্ধারণ করে আদালত। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, সিআইডি শুধু মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তই করছে না, যেসব খাত দিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে, সেসব খাত চিহ্নিত করার কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব কীভাবে বাংলাদেশে ব্যবসা করে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাঠাচ্ছে সে বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় জড়িত ১০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের ডাকা হয়। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়সহ নানা বিষয়ের সুনির্দিষ্ট দালিলিক তথ্য-প্রমাণ দাখিল করতে তাদের বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২৭ ফেব্রুয়ারি চাল ডাল ডট কম, বিক্রয় ডট কম, রকমারি ডট কম, আজকের ডিল, ফুড পান্ডা, দারাজ, খাজ ফুড, অথবা ডট কম, পিকাবো ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেড ডটকমের একজন করে প্রতিনিধি সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। এর আগে ওইসব প্রতিষ্ঠান বরাবর চিঠি পাঠায় সিআইডি। এসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের অর্থ লেনদেনের সুনির্দিষ্ট দালিলিক প্রমাণাদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাখিল করতে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে দেশে অনলাইনে কেনাবেচায় যুক্ত এমন আরও অন্তত ১০টি কোম্পানির কর্মকা- খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলছেন, চীনভিত্তিক আলীবাবা ডট কম, সাদমার্ট ডটকম, হুক্কাহুসহ অন্তত পাঁচটি বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে অনলাইনে তাদের কেনাবেচা চালাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আলীবাবা ডট কম দেশীয় কোম্পানি দারাজের সঙ্গে কাজ করছে। তবে অর্থ পাচার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, এনবিআর ও দুদক সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও ফাইনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, অর্থ পাচার প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে। এতে তথ্য আদান-প্রদান সহজ হয়েছে। ফলে পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। একই সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রম চালানোও সহজ হবে। রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছর ১৮ এপ্রিল হাই কোর্টের নির্দেশ ছিল, গত ১০ বছরে ইন্টারনেটভিত্তিক কেনাবেচা কিংবা লেনদেনে কী পরিমাণ ভ্যাট, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া হয়েছে তার হিসাব দাখিল করা। একই সঙ্গে একই সময়ে ইন্টারনেটভিত্তিক ফেসবুক, ইউটিউবে যে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন দিলে, ডমেইন কিনলে কিংবা রেজিস্ট্রেশন করলে তার ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। তবে ৭ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) ওপর এ অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। আজ পুনরায় এ বিষয়টির ওপর শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।

সিআইডি সূত্র বলছে, অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও ১২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে আইয়ুব ব্রাদার্স, অ্যাসেঞ্জার ও ঢাকা হাইডস্কিন কোম্পানির প্রতিটির বিরুদ্ধে ২০০ কোটি টাকা করে, আল মদিনা ট্যানারির বিরুদ্ধে ৪৩ কোটি টাকা, অ্যানগন লেদারের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা, বিএলসি কোম্পানি ও ইব্রাহিম লেদারের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ১৫ কোটি টাকা করে, আঞ্জুমান ও মিল্লাত ট্যানারির বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকা করে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ এলেও কী পরিমাণ অর্থ তারা পাচার করেছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে মোল্যা নজরুল ইসলাম বলন, তদন্তে দেখা গেছে অধিকাংশ অর্থ পাচারের ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত। কোন কোন ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার বেশি হয় সুনির্দিষ্ট করে তা না বললেও রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অর্থ পাচারে সহযোগিতা করা এবং অর্থ পাচারের ঘটনা বেশি ঘটার তথ্য মিলেছে।

সর্বশেষ খবর