মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
ভিডিও কনফারেন্সে চার প্রকল্প উদ্বোধন

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে হাসিনাই প্রেরণা : মোদি

নয়াদিল্লি প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেক, ঢাকা

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে হাসিনাই প্রেরণা : মোদি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন -বাসস

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার ঘোষণা দিলেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। গতকাল নয়াদিল্লি থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ঢাকা থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিবহন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা-সংক্রান্ত চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার উন্নয়ন দূরদর্শিতা এ সম্পর্ক গড়ার পথের সোপান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেশকে ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত হিসেবে গড়ে তোলার সাহসী কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, তাতে আমরা সহযোগিতা করার সুযোগ পাওয়ায় গর্বিত। বাংলাদেশের সোনালি অধ্যায় গড়তে ভারত সব সময়ই পাশে থাকবে। এই যজ্ঞে শামিল হতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি রোল মডেল। বহুমুখী ও বহুমাত্রিক সহযোগিতার ফলে আমাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্ববাসীর সম্মুখে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্তরূপে পরিগণিত হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বিগত এক দশকে উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রথাগত খাত- যেমন নিরাপত্তা, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ু ও পরিবেশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জনযোগাযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে সহযোগিতা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন ও অপ্রচলিত খাত- যেমন ব্লু ইকোনমি এবং মেরিটাইম, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, মহাকাশ গবেষণা, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ রপ্তানি এবং সাইবার সিকিউরিটি প্রভৃতি খাতে উভয় দেশ সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন। গণভবনে এ সময় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন ও ভারতের রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলী দাস উপস্থিত ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাউথ ব্লক দফতরে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, উপ-হাইকমিশনার রোকেবুল হক এবং বাংলাদেশ থেকে আগত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিকল্পধারার সংসদ সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে দুজন উপস্থিত ছিলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমে বাংলায় শুদ্ধ করে বলেন, ‘আশা করি বাংলাদেশের সকলেই ভালো আছেন।’ সবশেষে ফের বাংলায় বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক চিরজীবী হোক।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনের পরে এটা ষষ্ঠ ভিডিও কনফারেন্স। তাই আমি বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাতে চাই শেখ হাসিনা সরকারকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতিয়ে আনার জন্য। এটা ঐতিহাসিক বিজয়।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে যেভাবে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে, তাতে আশা করি আগামী পাঁচ বছরে তা নতুন শিখরে পৌঁছাবে।’ এ সময় বাংলাদেশ থেকে আসা ১৭ সদস্যের একটি যুব রাজনৈতিক প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ উচ্ছেদে তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি ‘শূন্য সহনশীলতা’র নীতি পোষণ করে এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে কখনোই বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় প্রদান করা হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের এ অঞ্চল এবং এর বাইরে সন্ত্রাসবাদ দূর করতে আমরা বদ্ধপরিকর।’ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের এ অঞ্চল এবং এর বাইরে সন্ত্রাসবাদ দূর করতে আমরা বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি ‘শূন্য সহনশীলতা’র নীতি পোষণ করে। কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে কখনোই বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া হবে না।’’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘টানা তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর আপনার সঙ্গে আমার এটাই প্রথম ভিডিও কনফারেন্স। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে আমাদের বিজয় ঘোষণার পরপরই আমাকে ও আমার দলকে অভিনন্দন জানানোর জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী মোদি তার ভাষণে বলেন, ‘পুলওয়ামার নিহত জওয়ানদের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। এই মার্চ মাস বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আগামী ১৭ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদ্্যাপিত হবে। তারপর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। এই সময়ে দুই দেশের কোটি কোটি মানুষ হোলি উৎসব উদ্্যাপন করবেন। এই মাসে প্রকল্প উদ্বোধন অত্যন্ত শুভ।’ মোদি বলেন, ‘যখনই ভারত-বাংলাদেশ কানেকটিভিটির কথা হয় তখনই আমার মনে হয় এটা সম্ভব হচ্ছে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতির কারণে। আজকের প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন জড়িত।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত থেকে দোতলা বাস, একতলা এসি ও নন-এসি বাস এবং ট্রাক আমদানি; ভারতীয় আর্থিক অনুদানে পাঁচ জেলায় (জামালপুর, শেরপুর, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন; ভারতীয় অনুদানে বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলার ভা ারিয়ায় ১১টি পানি শোধনাগার স্থাপন; এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভারতের ন্যাশনাল নলেজ নেটওয়ার্ক (এনকেএন) সম্প্রসারণের আওতায় বাংলাদেশে সেই নেটয়ার্কের সম্প্রসারণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।’ তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এলওসির আওতায় ৬০০ বাস (৩০০ দোতলা বাস, ২০০ একতলা এসি বাস এবং ১০০ একতলা নন-এসি বাস) এবং ৫০০ ট্রাক (৩৫০টি ১৬-টনি ট্রাক এবং ১৫০টি ১০-টনি ট্রাক) বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের বহরে যুক্ত হতে যাচ্ছে। আশা করি, এর ফলে বাংলাদেশের যাত্রীসাধারণের দুর্ভোগ কিছুটা লাঘব হবে। এ ছাড়া আমাদের মহাসড়কগুলোর যানজট খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।’

বাংলাদেশের ১৭ সদস্যের এক রাজনৈতিক প্রতিনিধি দল গতকালের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তাদের মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত করেন। তারা রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গেও দেখা করবেন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা হলেন উপদফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, ছানোয়ার হোসেন, জুয়েল আরেং, ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল, নাহিম রাজ্জাক, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, সাবেক সংসদ সদস্য অনুপম শাহজাহান জয়, দলের নেতা সুফি ফারুক ও উম্মে রাজিয়া।

বিএনপির পক্ষ থেকে গেছেন সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানান।

জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলে আছেন সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ও সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া চৌধুরী। বিকল্পধারার পক্ষে যুগ্ম-মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরী এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) এখন ভারতে। এ ছাড়া প্রতিনিধি দলে আছেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ তৈয়বুল বাশার মাইজভান্ডারি। প্রতিনিধি দলটি ১৬ মার্চ পর্যন্ত ভারতের নয়াদিল্লি ও মুম্বাই সফরে থাকবে। এ ছাড়া আজ ভারতের রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বেংকাইয়া নাইডু ও লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা আছে তাদের। এদিন থিংক ট্যাংক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করবেন তারা। পরে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির বিদেশবিষয়ক কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বসবে দলটি।

সর্বশেষ খবর