বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

শোভন জয় করেছে পরাজিত হয়েছে প্রশাসন, শপথ নিয়ে নুরের লড়াই বাকি

পীর হাবিবুর রহমান

শোভন জয় করেছে পরাজিত হয়েছে প্রশাসন, শপথ নিয়ে নুরের লড়াই বাকি

ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের সঙ্গে আমার কোনো জানাশোনা নেই। কখনো পরিচয়ও হয়নি। টেলিফোনেও কথা হয়নি। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে দু-তিনবার টেলিফোনে কথা হয়েছে। আলাপ-আলোচনায় তাকে প্রাণবন্ত ও বিনয়ী মনে হয়েছে। ডাকসুতে ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী শোভন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরের কাছে প্রায় ২ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন। তার পরাজয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মেনে নেননি। ভিপি পদে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে ভিসি ভবনের সামনে ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শোভন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সেই অবস্থান থেকে সরিয়ে এনেছেন। তার জন্য কর্মীরা কেঁদেছেন। সুদর্শন শোভনের মায়াভরা মুখ যখন টিএসসিতে বিজয়ী ভিপি নুরকে বুকে টেনে নিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং একসঙ্গে ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষায় ও ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন তখন গোটা বাংলাদেশের হৃদয় জয় করেছেন। যেন হেরে গিয়েও শোভন জয়ী হয়েছেন!

নুরকে বুকে টেনে শোভনের উষ্ণ অভিনন্দন যেন গণতন্ত্রের জন্য শোভনের সৃষ্টি অপূর্ব শোভা যা আমাদের মুগ্ধ করেছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় জেনেই অংশ নিতে হয়। ব্যালটের শক্তিই এখানে বড়। ভোটারের হৃদয় জয় করেই নির্বাচনে জিততে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের সব নির্বাচনের মতো অবশেষে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সূতিকাগার ডাকসু নির্বাচন বহুল আশার আলো জ্বালিয়ে ২৮ বছর পর ধরা দিলেও সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা এখানে করুণভাবে পরাজিত হয়েছেন। আগেও বলেছি, এখনো বলছি, এক কুয়েত মৈত্রী হলের বস্তাভর্তি ব্যালট পেপার উদ্ধার প্রশাসনের নির্লজ্জ বেহায়াপনাকেই উন্মোচিত করেনি, শিক্ষকের মর্যাদা ছেড়ে একটি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের নগ্ন চেহারাই উন্মোচিত করেনি, ডাকসু নির্বাচনকেও কলঙ্কিত করেছে। প্রভোস্ট শবনম নায়িকার আসন পাননি খলনায়িকায় পরিণত হয়েছেন। সেখানে সাধারণ ছাত্রীরা প্রতিরোধ গড়ে নতুন করে ভোট আদায় করে পূর্ণ প্যানেলে তাদের জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন।

রোকেয়া হলে অনিয়ম হয়েছে। ছাত্রীরা বিক্ষোভ করেছেন। নেতারা মামলা খেয়েছেন। রোকেয়া হল ছাড়া সবকটি ছাত্রী হলে ছাত্রীরা স্বতন্ত্র প্যানেলে ছাত্রলীগকে পরাজিত করেছেন। ডাকসুর ঐতিহ্যের বীরত্বের জয় ছাত্রীরাই ঘটিয়েছেন। ছাত্র হলগুলোয় যদি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ক্যাম্পাসের মতো না হতো তাহলে ফলাফল ছাত্রী হলের মতোই হয়তো ঘটত। কি ছাত্রদল কি বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাস বা হলে হলে সংগঠন শক্তিশালী করতে পারেনি। তাদের চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ব্যক্তি ইমেজে হেরে গিয়েও চমক দেখিয়েছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের পূর্বসূরিদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে বিতর্কমুক্ত নির্বাচন দিতেও ব্যর্থ হয়েছে। মাঝখানে নিজেদের শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের প্রতি অতি উৎসাহী পক্ষপাতিত্বের নির্লজ্জ চরিত্র উন্মোচিত করেছেন।

এদিকে ফলাফলে গোলাম রাব্বানী কোটা সংস্কার আন্দোলনের জিএস প্রার্থী রাশেদ খানকে ৪ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন। এজিএস পদে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ১৫ হাজার ৩০১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। প্রায় ৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে কোটা আন্দোলনের প্রার্থী ফারুক হোসেনকে তিনি পরাজিত করেন। ফারুক পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৯৬ ভোট। ভিপি পদে স্বতন্ত্র জোটের প্রার্থী অরুণি সেমন্তী খান ২ হাজার ৬৭৬ ভোট পেয়েছেন। আর প্রগতিশীল ছাত্র জোটের প্রার্থী লিটন নন্দী পান ১ হাজার ২১৬ ভোট। ভিপি পদে সবচেয়ে কম ভোট পান ছাত্রদলের মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি মাত্র ২৪৫ ভোট পেয়েছেন। জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাংবাদিক আসিফুর রহমান তাসিন পান ৪ হাজার ৬২৮ ভোট। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সাফি আবদুল্লাহ ১ হাজার ৫১২ ভোট পান। কিন্তু ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান অনীক পান মাত্র ৪৬২ ভোট। ডাকসুতে ছাত্রদলের ভোট ছাত্রলীগকে পরাজিত করতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্যানেলে যে পড়েছে ভোটের চিত্র দেখলে সেটি অনায়াসে বলা যায়।

অন্যদিকে এজিএস প্রার্থী সাদ্দামের বিপুল ভোটপ্রাপ্তির নেপথ্যে তার সংগঠনের শক্তি সমর্থনই কাজে লাগেনি একজন তার্কিক হিসেবে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও কাজে লেগেছে। ক্যাম্পাসে তার জনপ্রিয়তা আগে থেকেই শোনা গেছে। তার সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু তার ভোটপ্রাপ্তি ও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা আমাকে চমকিত করেছে। ডাকসুর অতীত প্রার্থীরা এমনই হতেন।

ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন পরাজিত হয়েও যে ভূমিকা রেখেছেন সেটি তাকে বীতশ্রদ্ধ এই ছাত্র রাজনীতির দুঃসময়ে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছে। তার পরাজয়ের নেপথ্যে ছাত্রলীগের একাংশের ভোট না দেওয়ার আভাস প্যানেল চিত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ’৮০-’৮১ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের জিএস প্রার্থী বাহালুল মজনুন চুন্নু মাত্র ১০৫ ভোটে আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে পরাজিত হয়েছিলেন। সেদিনও ছাত্রলীগের একটি অংশ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ছাত্রলীগের একচ্ছত্র জয়ের মুখে নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে শোভন রাজনীতিতে জয়ী হয়েছেন। বৃহত্তর স্বার্থকেই বড় করে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে ছাত্র রাজনীতিতে মানুষের কাছে তার সিদ্ধান্ত ও ভূমিকা এবং আচরণ তাকে নায়কের আসন দিয়েছে। তার প্রতি মানুষের আবেগ অনুভূতি চিন্তা মননে ও কর্মে প্রতিফলন ঘটিয়ে আগামী দিনের রাজনীতিতে সঠিক দক্ষতা দেখাতে পারলে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি একদিন তার রাজনৈতিক জীবনে আসতে পারে। শোভন বড় ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হয়ে যে দায়িত্ব পালন করার কথা নিজেকে বলি দিয়ে হলেও সেটি করেছেন।

ডাকসুর ইতিহাসের ধারা ও ঐতিহ্য ভেঙে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির বাইরে থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদের সঙ্গে ভোটের দিন তিনিও নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। কিন্তু ফলাফলে তিনিসহ তার প্যানেলের দুজন বিজয়ী হয়েছেন। আগেই বলেছি, ছাত্র রাজনীতির দেউলিয়াত্বের পরাজয়, তার প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে দমন-পীড়নের কারণেই এই বিজয় ঘটেছে। কারণ সে দিন তিনি দমন-পীড়নের মুখে নত হননি। এতবড় বিজয় ডাকসুতে গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় ঘটিয়েছে। বন্ধ্যা ছাত্র রাজনীতিকে গতিময় ও গণতান্ত্রিক আলোর পথ দেখিয়েছে। হাতেগোনা ভোট পাওয়া ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সুর মিলিয়ে নুরুল হক নুরকে আলটিমেটাম ও নতুন নির্বাচনের দাবি প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে শপথ ও অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজন করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান, সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা নিশ্চিত এবং ছাত্রছাত্রীদের আবাসন সমস্যার সমাধান এবং হল থেকে বহিরাগতদের বিতাড়নের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। ডাকসুর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলা বিতর্ক শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে র মাধ্যমে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবহন থেকে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা আবাসন ও খাবারের মান নিশ্চিত করাসহ সব দাবিদাওয়া পূরণের নেতৃত্ব দিতে হবে।

নুরুল হক নুর এখন আর কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নন, তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত নেতাই নন সারা দেশের ছাত্র সমাজেরও প্রতিনিধি। ছাত্র রাজনীতিই নয়, জাতীয় রাজনীতির গতি প্রকৃতিও অবলোকন করে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করে দেশের মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখার জায়গায়ও অবতীর্ণ হয়েছেন। সবাইকে নিয়ে ডাকসুর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ এখন তার ওপর। ডাকসুর নির্বাচিত জিএস গোলাম রাব্বানীসহ সব সতীর্থকে নিয়ে আগামী দিনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখাসহ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।

এই মুহূর্তে হঠকারী পথ গ্রহণের সুযোগ নেই। নুরুল হক নুরকে বুঝতে হবে অতীতের ডাকসু ভিপি কারা হয়েছেন এবং তাদের দায়িত্ব কী ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ উচ্চ শিক্ষিত বিকৃত সরকারবিরোধী মূর্খরা যেমন তাকে আজন্ম সংগ্রামী জগৎ বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে তুলনা করে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নষ্ট করে দিতে চাচ্ছেন তেমনি কেউ কেউ তাকে ছাত্র সমাজের প্রত্যাখ্যাত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছাত্রশিবিরের লোক বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন। নুরকেই তার কর্মের মধ্যদিয়ে প্রমাণ করতে হবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং একজন সাধারণ ছাত্র থেকে ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে উঠে আসা একজন ছাত্রনেতা মাত্র। হঠকারিতা ও অহংকার স্পর্শ করলে আঁতুড়ঘরেই স্বপ্নের মৃত্যু হবে। অনেক দূর যেতে হলে অনেক ধীরস্থির চিন্তাশীল যেমন হতে হবে তেমনি জ্ঞানে গরিমায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। এই ডাকসু নির্বাচনে যদি কোটা সংস্কার আন্দোলন, বামপন্থি জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্যানেল দিতেন তাহলে ফলাফল আরও ভালো করতেন। এত কিছুর পরও যতটুকু পেরেছেন ততটুকু নিয়েই অগ্রসর হওয়া এবং আগামী দিনের সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতির আলোকিত পথ তৈরি করতে ভূমিকা রাখার এখনই সময়। তাই নতুন নির্বাচনের দাবি ও আলটিমেটাম নয়, শপথ গ্রহণ করে দায়িত্ব নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করাই হবে প্রধান কাজ।

সর্বশেষ খবর