সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী

ফিরে এসে পেলাম বনানীতে সারি সারি কবর

নিজস্ব প্রতিবেদক ও গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

ফিরে এসে পেলাম বনানীতে সারি সারি কবর

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল টুঙ্গিপাড়ায় আয়োজিত শিশু-কিশোরদের এক অনুষ্ঠানে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্ট স্বজন হারানোর বেদনা ও সেদিনের ঘটনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মাত্র ১৫ দিন আগে দেশ ছেড়ে যখন বিদেশে গিয়েছিলাম তখন বিমানবন্দরে সবাই বিদায় দিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসে কাউকে পাইনি। পেয়েছিলাম বনানীতে সারি সারি কবর। আর পেয়েছিলাম টুঙ্গিপাড়ায় আমার দাদা-দাদির কবরের পাশে শুয়ে আছেন আমার বাবা। ভাগ্যের এই বিপর্যয় ঘটবে, ভাবতে পারিনি।

অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিচারণের সময় উপস্থিত অনেককেই চোখ মুছতে দেখা যায়। গতকাল ঢাকাসহ সারা দেশে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়েছে জাতির জনকের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। আমি যখন বাংলাদেশে ফিরে আসি, জানতাম যে কোনো সময় হয়তো আমার বাবার মতো ভাগ্য আমাকে বরণ করতে হবে। কিন্তু কখনো আমি মৃত্যুভয়ে ভীত হইনি। আমারও প্রতিজ্ঞা ছিল বাবার স্বপ্ন পূরণ করে এই বাংলাদেশকে উন্নত করে গড়ে তুলব। পঁচাত্তরে সবাইকে হারানোর পর সমৃদ্ধ-উন্নত দেশ গড়তে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে ফিরে এসেছি। সেই সিদ্ধান্তের ওপর আজও পথ চলছি। তিনি বলেন, আমরা দুই বোন পরিবার হারিয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ হারিয়েছিল স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারেনি। ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছিল। কিন্তু সত্যকে কেউ ঢেকে রাখতে পারে না। সত্যের জয় হয়েছে। আজ বাংলাদেশের মানুষ যেমন ইতিহাস জানতে পারছে তেমনি যে ভাষণ ২১ বছর এ দেশের মাটিতে বাজানো যায়নি, সেই ভাষণ আজ বিশ্ব স্বীকৃত, বিশ্ব মর্যাদা পেয়েছে। শিশুদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা আর তাঁর নেতৃত্বের দূরদর্শিতার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, শিশুদের যে অধিকার সেটা যাতে নিশ্চিত হয় তার জন্য ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা শিশু আইন প্রণয়ন করেন। তখনো জাতিসংঘ শিশু আইন করেনি। কত দূরদর্শিতা ছিল তাঁর নেতৃত্বেৃর। আমরা তাঁর আলোকেই ২০১১ সালে জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করি।  বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, জাতির পিতা ছোটবেলা থেকেই মানব দরদি ছিলেন। আমার দাদির কাছে গল্প শুনেছি বঙ্গবন্ধু নিজের বই গরিব ছাত্রদের বিলিয়ে দিতেন। নিজের ছাতাও বিলিয়ে দিতেন। অনেক সহপাঠী বিভিন্ন বাসায় লজিং থেকে পড়াশোনা করতেন। তাদের বাড়িতে ডেকে এনে বঙ্গবন্ধু নিজের খাবার ভাগ করে খেতেন। আমার দাদা-দাদি সব সময় আমার বাবাকে বকাঝকা না করে উৎসাহ দিতেন। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন যে রাজনীতি করেছেন, তাঁর বাবা-মা সেই সমর্থনটা দিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্য-পীড়িত মানুষগুলোকে দেখে বঙ্গবন্ধুর হৃদয় কাঁদত। তাই তিনি নিজের জীবনের সব কিছু বিলিয়ে দিয়েছেন এ দেশের মানুষের জন্য। আর এ কারণেই বছরের পর বছর কারাজীবন ভোগ করেন তিনি। কোনো অত্যাচার নির্যাতন বা ফাঁসির দড়িও তাঁকে বাধা দিতে পারেনি। তিনি তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত রেখে আমাদের স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছেন। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে গোপালগঞ্জ জেলা শহরের মালেকা একাডেমির পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া সিকদার। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখে শিশু আরাফত হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। এ সময় অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার ও গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বঙ্গবন্ধুকে লেখা চিঠি’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন। বঙ্গবন্ধুকে লেখা শ্রেষ্ঠ চিঠি পাঠ করেন যশোরের কেশবপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। পরে প্রধানমন্ত্রী ‘আমার কথা শোন’ শীর্ষক ভিডিও প্রদর্শন ও জাতীয় কাব্য নৃত্যগীতি আলেখ্যানুষ্ঠান উপভোগ করেন। প্রধানমন্ত্রী চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গল্প বলা প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রযোগিতা ও ৭ মার্চের ভাষণ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার এ টি এম ফজলে রাব্বি মিয়া, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ দলীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন : বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল ভোরে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়। ভোর সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ৭টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে যান। সেখানে তিনি কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটির উদ্যোগে বধির ছাত্র-ছাত্রীদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। পথশিশুদের নিয়ে গতকাল দুপুরে শশিমহন বসাকে দলীয় কার্যালয়ে পথশিশুদের নিয়ে কেক কাটেন ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন। এ সময় শিশুদের মাঝে কেক, মিষ্টি ও খাবার বিতরণ করা হয়।

ভিন্ন আয়োজনে সিআরআই : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী এবং জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে শিশু-কিশোরদের জন্য ভিন্নধর্মী এক আয়োজন করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে শিশু-কিশোরদের জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কমিকস ও ড্রয়িং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেয় শতাধিক শিশু। প্রতিযোগিতা শেষে কমিক ও নন-কমিক এ দুই ক্যাটাগরিতে ৩ জন করে মোট ৬ জনকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এর পাশাপাশি ধানমন্ডি-৩২ নম্বর রোডে ঢোকার মুখে উন্মুক্ত স্থানে সিআরআই আয়োজন করে ‘পাপেট শো’। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের অডিটরিয়ামে প্রদর্শন করা হয় বাংলাদেশে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পাওয়া ডকুড্রামা ‘হাসিনা : এ ডটারস টেল’। জাতীয় শিশু দিবস পালন বিজিবির : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে গতকাল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের র‌্যালি : এ উপলক্ষে র‌্যালি করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। সকালে ধানমন্ডিতে র‌্যালি ও সমাবেশে আবদুল হাই, হারুনুর রশিদ, সফিকুল বাহার মজুমদার টিপু, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ীসহ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা এতে অংশ নেন। পরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা অর্পণ ও স্যালুট করেন।

তারুণ্যের জয়যাত্রার নানা আয়োজন : জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করেছে রাজধানীর ভাসানটেক দ্বীন মোহাম্মদ কলোনির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তারুণ্যের জয়যাত্রা। শিশুদের নিয়ে র‌্যালি, চিত্রাঙ্গন ও গণিত প্রতিযোগিতা, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আবদুস শহীদ, এডিশনাল এসপি আবদুল্লাহ আল ইয়াছিন শুভ্র এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনের সার্কুলেশন বিভাগের প্রধান মো. বিল্লাল হোসেন মন্টুকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম : বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা এবং শিশু সমাবেশ করেছে। সার্কিট হাউস থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রার সামনে ছিল প্রায় অর্ধশত শিশু, যাদের প্রত্যেকের বেশ-ভূষণে ছিল জাতির জনকের আদল।

তার আগে শিল্পকলা প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। 

এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কেক কাটা ও  বেলুন উড়ানো কর্মসূচি উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের কর্মকর্তারা।

রাজশাহী : রাজশাহী সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের নেতৃত্বে নগরীর কুমারপাড়া থেকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এতে অংশ নেয় নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

খুলনা : বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের আগে খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদ, বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া, খুলনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ, কেএমপির ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার সরদার রকিবুল ইসলামের উপস্থিতিতে নগরীতে র‌্যালি বের করা হয়।

বরিশাল : জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার  মো. ইউনুস ও মহানগর সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলালের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

সর্বশেষ খবর