সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
একান্ত আলাপচারিতায় লেখিকা অরুন্ধতী রায়

আমন্ত্রণ পেলে আবার আসব

যেতে চাই বরিশাল
বাংলা বই ওভাবে পড়া হয়নি
সাহিত্যিক পরিচিতি আমাকে আলোড়িত করে

নঈম নিজাম, দিল্লি থেকে ফিরে

আমন্ত্রণ পেলে আবার আসব

দ্য গড অব স্মল থিংস উপন্যাসের বুকার জয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, এবার ঢাকায় এসে অনেক প্রতিকূল অভিজ্ঞতা হলেও আবার আমন্ত্রণ পেলে অবশ্যই বাংলাদেশে আসব। পূর্বপুরুষের বাড়ি বরিশালেও যাওয়ার ইচ্ছা আছে। তিনি বলেন, আমি অনেক ধরনের কাজ করি এ কথা ঠিক। কিন্তু অনেক পরিচয়ের মাঝে লেখিকা পরিচয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। গত ৭ মার্চ ঢাকা থেকে বিমানে দিল্লি যেতে যেতে দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন। আমার সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল না এই বিখ্যাত লেখিকার। ব্যক্তিগত কাজে দিল্লি যাওয়ার সময় প্রথম শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আমার পাশের লাইনে তাঁকে দেখলাম নীরবে অপেক্ষা করছেন। হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় আমি বললাম, ঢাকা সফর কেমন হলো? তিনি হাসিমুখে বললেন, ভালো। একই ফ্লাইটে যাচ্ছি বুঝতে পারলেও কিন্তু তখনো বুঝে উঠতে পারিনি আমরা পাশাপাশি আসনের যাত্রী। নিরাপত্তা তল্লাশি সেরে একটু বিলম্বেই আমি ফ্লাইটে উঠি। জেট এয়ারওয়েজের বিজনেস ক্লাসের প্রথম আসনেই তিনি বসা। পাশের আসনটি আমার। তিনি কিছুটা ঘুম ঘুম চোখে ছিলেন। ফ্লাইট ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে তাকালেন। শুভেচ্ছা বিনিময়ে শুরু হলো আলাপচারিতা। ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের ফ্লাইটের বেশির ভাগ সময় তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। চমৎকার একজন মানুষ।

আপনার ঢাকা সফর কেমন হলো?

- ভালো হয়েছে। এখানকার মানুষ আন্তরিক।

- এটা কি আপনার প্রথম সফর?

- হ্যাঁ, ঢাকায় এটা আমার প্রথম সফর। এর আগে বাংলাদেশে আসা হয়নি।

- আপনার পূর্বপুরুষরা কিন্তু বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলের।

- মনে হয় আমার দাদা অথবা বাবার দাদার বাড়ি ছিল। কিন্তু আমাদের কখনো আসা হয়নি।

- এবার সফরকালে কিছু ঝামেলা হলেও শেষ পর্যন্ত সব কিছু ভালোভাবে সম্পন্ন হয়।

- আমি বাংলাদেশে আসার আগে ভাবতে পারিনি এত মানুষ আমার বই পড়েছে, তারা আমার কথা শুনতে চায়। অনুষ্ঠান নিয়ে শুরুতে সমস্যা ছিল কিছু।

- শেষ পর্যন্ত সেই সমস্যা তো কেটেছিল। আপনিও এমন কিছু বলেননি, যা হুলস্থূল বাধতে পারে।

- হ্যাঁ, তা কেটেছিল। মানুষের অনেক ভিড় ছিল। মিডিয়া ছিল অনেক। এর মাঝে পুলিশের লোকজন এসে আমার ভিসা দেখতে চাইলেন। আমি তাদের বললাম, ভিসা নিয়েই তো এসেছি। আপনাদের দূতাবাস ভিসা দিয়েছে। বলুন তো এটা কোনো কথা হলো। আমি অবাক হয়েছিলাম। আমি পুলিশকে বললাম, অনুষ্ঠানের মাঝেই দেখবেন? তবে মানুষের উপস্থিতি, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারাটা ছিল অনেক আনন্দের। পরে আমাকে আনিসুল হক আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। আমি তাকে বললাম, শহীদুলকে নিয়ে যাব। আনিস বলল, শহীদুলকে নেওয়া যাবে না। তখন আমি বললাম, তাহলে আমি কী করে যাই। এখানে এসেছি শহীদুলের আমন্ত্রণে। এই কারণে আর সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করা হলো না।

- আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে একটা কথা বলছি, তিনি আড্ডায় অসাধারণ। অনেক পড়াশোনা করেন। সাহিত্যের বই বেশি পড়েন। লেখক-সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্প করেন। তাঁর সঙ্গে আড্ডায় আমার মনে হতো, তিনি বড়বোন টাইপের। আমি সিউর প্রধানমন্ত্রী আপনার বই পড়েছেন।

আমার কথায় হাসলেন তিনি। বললেন, আমি আসলে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণে যেতে অভ্যস্ত নই। মানুষের জন্য কাজ করতে, কথা বলতে বেশি পছন্দ করি।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন। সাহিত্য চর্চাসহ অনেক কিছু করেন। চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করেছেন। কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষেও কথা বলেছেন। মাওবাদীদের প্রতিও সমর্থন ছিল আপনার। প্রতিবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। ভারতের পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ইরাক নিয়ে কথা বলেছেন। আপনার মাঝে প্রতিবাদী একটি চরিত্র খুঁজে পাই। আবার পড়াশোনা করেছেন স্থাপত্যবিদ্যায়। কোন পরিচয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

- সমাজের অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে পছন্দ করি। কিন্তু সাহিত্যিক পরিচয়টাই আমাকে আলোড়িত করে। এই পরিচয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

- ফিকশন ছাড়াও অনেক কিছু নিয়ে লিখেছেন। আপনার বইয়ের সংখ্যা তো ৪টি।

- হুম ।

- ভবিষ্যতে বড় কোনো কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?

- আছে। ভালো কিছু লিখতে চাই।

- বাংলাদেশের কোনো বই পড়েছেন কি?

- না, ওভাবে পড়া হয়নি। আনিসুলের একটা বইয়ের কিছু অংশ পড়েছি।

- কোন বই? এটা কি তার লেখা উপন্যাস ‘মা’?

- হ্যাঁ, তার লেখা ‘মা’। তসলিমার লেখা পড়েছি আগে। ওকে পশ্চিমবঙ্গে বামেরা নিষিদ্ধ করার পর আমি তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। আমি বুঝি না রাজনীতিবিদরা তা কেন করতে দেন না।

- আপনার সেরা লেখা গড অব স্মল থিংকস কত বছর বয়েসে লেখা?

- তখন আমার বয়স মাত্র ৩৭ বছর। ১৯৯২ সালে।

- এই বয়সেই বাজিমাত। এক উপন্যাসই আপনাকে বিখ্যাত করে দিল। বাংলাদেশে এর অনুবাদ পাওয়া যায়, জানেন তো?

- শুনেছি। কিন্তু কেউ আমার অনুুমতি নেয়নি। দুর্বল অনুবাদ। অনুমতি নিয়ে অনুবাদ করলে ভালো হতো। বইটি ভালোভাবে পাঠকের কাছে যেত।

- কেউ অনুুমতি চাইলে দেবেন?

- অবশ্যই দেব।

- আপনার আরেকটি উপন্যাস আছে দ্য মিনিস্ট্রি অব দ্য আটমোস্ট হ্যাপিনেস। শক্তিশালী লেখনীগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে।

- সবাই কিন্তু অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করছে তা না। অনেকে নিজেদের মতো করে প্রকাশ করছে।

- আপনার শখ কী?

- জিম করতে ভালো লাগে। গানও শুনি।

- কেরালার জীবন কেমন ছিল?

- আপনি তো জানেন কেরালার শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। ওখানকার ছিমছাম জীবন।

কথায় কথায় জেটএয়ার এগিয়ে চলে দিল্লির পথে। হঠাৎ প্রশ্ন করেন, আপনার সঙ্গে শহীদুলের সম্পর্ক কেমন? জবাবে আমি বললাম, তিনি আমাকে ভালো করে জানেন না। আমিও ওভাবে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত নই। তবে তার কাজ সম্পর্কে জানি। নতুন প্রজন্ম তাকে পছন্দ করে। আমাকে কিছুদিন আগে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমার কন্যা শহীদুলের আটকের সময় তার পক্ষে একটি লেখা লিখেছে। লেখাটি সেই কর্মকর্তা পড়েছেন। কিন্তু আমি পড়তে পারিনি। ফ­াইটে ওঠার পর মেয়েকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম, আমার পাশের আসনের যাত্রী অরুন্ধতী রায়। মেয়ে বলল, ও মাই গড। মাস্ট তাঁর সঙ্গে কথা বলবে। অরুন্ধতী হাসলেন। আমিও আবার গল্প শুরু করি।

- আপনাকে বাংলাদেশে আবার আমন্ত্রণ জানালে আসবেন?

- অবশ্যই আসব। তবে স্বাভাবিকভাবে আমন্ত্রক প্রতিষ্ঠান পছন্দ হতে হবে।

- সরকার আমন্ত্রণ জানালে?

- সরকারের সঙ্গে তো আমার কোনো কাজ নেই। আমি লেখালেখি করি। অবহেলিত মানুষের পক্ষে কাজ করি। কাশ্মীরের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার কারণে আমার দেশের অনেকে আমার ওপর বিরক্ত। এই যে এখন কী চলছে বুঝতে পারি না। ভারতের মিডিয়াগুলোও একতরফা হয়ে উঠছে।

- বরিশাল যাওয়ার কখনো সুযোগ পেলে যাবেন?

- হুম, যেতে পারি। আগ্রহ রয়েছে।

- বাংলা বোঝেন অথবা কিছু কিছু কি বলতে পারেন?

- না, একদম বুঝি না। বলতেও পারি না। পড়তেও পারি না।

- আপনার বাবা কখনো বাংলা বলার চেষ্টা করেননি আপনার সঙ্গে?

- আমার দুই বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে আমরা চলে যাই কেরালাতে। এরপর বাবার সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নেই। ২২ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে আবার দেখা পারিবারিক পরিবেশে। তখন তিনি অতিরিক্ত পান করতেন। এনডিটিভির টপ বস প্রণয় রায় আমার কাজিন। ওর বাবা আর আমার বাবা ভাই। কাকার বাড়িতে দেখা। বাবা আর কথা বলার পর্যায়ে ছিলেন না। এতটাই খেয়েছিলেন। পরে তিনি আসলে বেশির ভাগ সময় ড্রিংকের ওপর থাকতেন। স্বাভাবিক জীবন ছিল না। এই কারণে বাবাকে সেভাবে পাওয়া হয়নি।

- ছোটবেলা তো আপনার কেরালাতেই কেটেছে?

- শিলং থেকে চলে গেলাম কেরালা। মায়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। আমার যা কিছু স্মৃতি মায়ের সঙ্গে। ছোটবেলায় মাকে নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা।

- কেরালাতে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। ছবি দেখেই ভালো লাগে। সুযোগ পেলে একবার কেরালা যাব।

কথায় কথায় দিল্লি চলে এলো। আরও অনেক কথা হয়েছিল। দিল্লি বিমানবন্দরে বিদায় মুহূর্তে বললেন, যোগাযোগ রাখবেন। আমি বললাম, অবশ্যই রাখব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর