মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

আবজালের সম্পত্তি ক্রোক সাইনবোর্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাস্থ্যের সেই আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের অবৈধ সম্পদের মধ্যে পাঁচটি স্থাবর সম্পদ ক্রোক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা স্বাস্থ্য অধিদফতরের আবজাল হোসেন দম্পতির ২৫টি বাড়ি-প্লট ও জমি জব্দের আদেশ বাস্তবায়নে সম্পত্তিগুলোতে ক্রোক-আদেশের সাইনবোর্ড স্থাপন শুরু করেছে দুদক। গতকাল দিনের শুরুতে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের পাশে সাড়ে তিন কাঠা প্লটে ছয়তলা বাড়িতে প্রথম বিলবোর্ডটি লাগানো হয়। এ বাড়ির মালিক আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানম। আবজাল হোসেন দম্পতির দুর্নীতি অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও সংস্থার উপ-পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম, উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম এবং উপ-পরিচালক এ কে এম মাহবুবুর রহমানের সমন্বয়ে দুদকের একটি কমিটি ক্রোক-আদেশের বিলবোর্ড স্থাপন করে। এরপর পাশের আরও একটি বাড়ি, একটি ফ্ল্যাট ও দুটি প্লটে একই ধরনের বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়।

দুদক টিম প্রথমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের সম্পদ ক্রোক করে। দুদক টিম উত্তরা মডেল টাউনের ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের ৪৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের ‘তামান্না ভিলায়’ ক্রোকের বিলবোর্ড লাগায়। এরপর অন্য চারটি বিলবোর্ড স্থাপন করে। আবজাল হোসেন উত্তরার ওই বাড়ির পাঁচতলায় থাকতেন। অভিযানের সময় বাড়িটি তালাবদ্ধ ছিল। আবজাল হোসেন কোথায় আছেন তাও কেউ জানাতে পারেননি। দুদকের উপ-পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি দল এ কাজ সম্পন্ন করে। পর্যায়ক্রমে আবজালের সব অবৈধ সম্পদ ক্রোক করা হবে বলে জানান তিনি। এ সময় ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বাড়ির কেয়ারটেকার মামুন হোসেন বলেন, আবজাল তার স্ত্রী ও পরিবারসহ এ বাড়িতে থাকতেন। গত ২১ জানুয়ারি নোটিস জারির পর তারা এখান থেকে চলে গেছেন। কোথায় আছেন জানেন না বলে জানান। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন পান সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ চড়েন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের গাড়িতে। ঢাকার উত্তরায় তার ও তার স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে অন্তত তিন-চারটি। আরেকটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২০টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে গত ১০ জানুয়ারি আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রুবিনা খানমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৭ জানুয়ারি দুদকে হাজির থাকতে বলা হলেও তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন। এর আগে আবজাল ও রুবিনার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। দুদক কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উত্তরার আবজালের ওই বাড়িতে বর্তমানে আটটি পরিবার ভাড়া থাকেন। ভাড়াটেদের কী হবে। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গত ২১ জানুয়ারি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক অর্থাৎ হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন জব্দ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেয় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। আবজাল হোসেনের বাড়ি ফরিদপুরে। ১৯৯২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তার। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সুপারিশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঁচটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন তিনি। ২০০০ সালে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে তিনি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে বদলি হন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি বর্তমান পদে যোগ দেন। সম্প্র্রতি সাতক্ষীরায় বদলি করা হলেও দুই মাসের মধ্যেই ঢাকা ফিরে আসেন আবজাল। আবজাল হোসেনের স্ত্রী রুবিনা খানম একই প্রকল্পে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে ব্যবসা শুরু করেন। মূলত স্বামী-স্ত্রী মিলে স্বাস্থ্য অধিদফতরে একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য তারা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন বলে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন। এ ছাড়াও অফিস সহকারী বা কেরানি হিসেবে চাকরি নিলেও আবজাল হোসেন অল্প সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, বিএনপি আমলে নিয়োগ পেলেও সব আমলেই সমানভাবে প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। নিয়োগ, বদলি-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, কাজ না করে বিল তুলে নেওয়ার মতো কাজগুলো করেছেন আবজাল। সেই আবজালের সম্পদ ১৫ স্বজনের কাছেও! : আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানম এবং তাদের ১৫ নিকটাত্মীয়ের আরও সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুদক। সুনির্দিষ্টভাবে এ ১৫ জনের সম্পদের খোঁজ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয় চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। দুদকের অনুসন্ধান দলের ধারণা, আবজালের যেসব সম্পদের তথ্য তাদের হাতে আছে, তার বাইরেও অনেক সম্পদ রয়েছে। আবজাল দম্পতি তাদের নিকটাত্মীয়দের নামে ওই সব সম্পদ করেছে। তাই ওই সব সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আবজালের শাশুড়ি তার নামে থাকা একাধিক স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছেন বলেও তথ্য রয়েছে। তথ্য পেয়েই সেসব সম্পদের কাগজপত্র আইন অনুযায়ী জব্দ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে অনুরোধ করা হয়েছে। দুদক যাদের বেনামে সম্পদের তথ্য পেয়েছে, তারা হলেন আবজাল হোসেন, তার স্ত্রী রুবিনা খানম, আবজালের ছেলে রুলমান আহমেদ রাকিব, দুই মেয়ে আনিকা সুলতানা রুপা ও আদিবা সুলতানা রথি, শ্বশুর জয়নাল তালুকদার, শাশুড়ি রেহেনা বেগম, তিন শ্যালক রফিকুল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম; তিন শ্যালকের স্ত্রী রুমানা, রুমা খান ও লিমা আক্তার; দুই ভাই বেলায়েত হোসেন ও লিয়াকত হোসেন, দুই ভাইয়ের স্ত্রী ঝর্না আক্তার ও নাসরিন আক্তার লাকি। এদের মধ্যে আবজালের দুই ভাই ও তিন শ্যালককে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এই পাঁচজনও স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত। আবজালের দুই ভাই হলেন ফরিদপুর টিবি হাসপাতালে ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন ও জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারে হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন। তিন শ্যালক হলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়ি চালক রকিবুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী রেজাউল ইসলাম বুলবুল এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম। আবজালের জব্দ সম্পদের তালিকা : রাজধানীর মিরপুরে আড়াই কাঠা জমির ওপর টিনশেড বাড়ি। পল্লবীতে ছয় কাঠা জমি। উত্তরার ১৫/সি নম্বর সেক্টরে তিন কাঠা জমির ২৪ নম্বর প্লট। উত্তরার ১৫/সি নম্বর সেক্টরে তিন কাঠা জমির ২৬ নম্বর প্লট। খিলক্ষেতে তিন কাঠা জমি। ভাটারা এলাকায় চার কাঠার প্লট। ফরিদপুরের কোতোয়ালি পৌরসভা মৌজা এলাকায় সাড়ে ১০ শতাংশ জমিতে দোতলা বাড়ি। একই এলাকার রঘুনন্দনপুর মৌজায় সাড়ে ১৩ শতাংশ জমি। জেলার পশ্চিম টেপাখোলা এলাকায় ১১৩ শতাংশ জমি। রাজবাড়ী জেলার বসন্তপুর ইউনিয়নে ২৩০ শতাংশ জমি। খুলনা সিটি করপোরেশনের খালিশপুর বয়রা মৌজায় সাড়ে ৫ কাঠা জমি। একই সিটি করপোরেশনের মুজগুনি আবাসিক এলাকায় সাড়ে তিন কাঠা প্লট। স্ত্রী রুবিনার জব্দ সম্পদের তালিকা : রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কে সাড়ে তিন কাঠা প্লটে ছয়তলা বাড়ি। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর সড়কে তিন কাঠা প্লটে ছয়তলা বাড়ি। ঢাকার মিরপুরে একটি টিনশেড বাড়ি। পল্লবীতে আড়াই কাঠা জমি। ভাটারা আবাসিক প্রকল্পকের এন ব্লকে তিন কাঠার একটি প্লট। ভাটারা আবাসিক প্রকল্পের একই ব্লকে তিন কাঠার একটি প্লট। ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় একটি মার্কেটের দোকান। ঢাকা জেলার সাভার উপজেলায় ১৫ শতাংশ জমি। ফরিদপুর পৌরসভার হাবেলী গোলাপপুরে দোতলা বাড়ি। একই জেলার চর পশ্চিম টেপাখোলা এলাকায় আট শতাংশ জমি। জেলার একই এলাকায় নয় শতাংশ জমি। জেলার একই এলাকায় সাড়ে পাঁচ শতাংশের আরেকটি জমি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর