মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ

একাত্তরের এদিনটি ছিল লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টাদশ দিন। এদিন সকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তৃতীয় দফা বৈঠক করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। ১৭ মার্চের নিষ্ফল বৈঠকটি এক ঘণ্টার কম সময়ে শেষ হলেও এবারের আলোচনা চলে ৯০ মিনিট। পরে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, জেনারেল ইয়াহিয়া বাস্তবতা অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আরও সময় প্রয়োজন। আমরা আগামীকাল সকাল ১০টায় আবার বসব। এর আগে সন্ধ্যায় উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক হবে।’ এদিকে সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে ধারাবাহিক আলোচনার মধ্যেই এদিন দুপুরে সৈন্যরা জয়দেবপুরে (গাজীপুর) জনতার বিক্ষোভে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে। ঝরে যায় ২০টি তাজা প্রাণ। আহত হন শতাধিক। ঘটনাটি সারা দেশে বিক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেয়। উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। এদিনই স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ হয়। জয়দেবপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের বাঙালি সৈনিক ও কর্মকর্তারা বিদ্রোহ করেন। শুরু হয় গোলাগুলি। ঘটনা জানতে পেরে আশপাশের গ্রামবাসী স্থানীয় জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি সৈনিকদের পক্ষে অবস্থান নেন। নতুন মাত্রা পায় স্বাধীনতা আন্দোলন। বিকালে বঙ্গবন্ধু জয়দেবপুরের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘যারা মনে করেন, বুলেট বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে গণআন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে- তারা আহাম্মকের স্বর্গে বসবাস করছেন।’

 বিজ্ঞান কর্মচারীদের মিছিলে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আর কত রক্ত চাও? আর কত রক্ত পান করলে তোমাদের তৃষ্ণা মিটবে? আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান চেয়েছি আর তোমরা চাও অস্ত্রের জোরে, শক্তির জোরে শাসন করতে। কিন্তু বাঙালিদের শক্তির জোরে দাবিয়ে রাখা যাবে না।’ ধানমন্ডির বাসভবনের সামনে জমায়েত সর্বস্তরের মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি কখনই বাংলার জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। বাঙালির দাবি আদায়ের জন্য ফাঁসিকাষ্ঠে গেছি। বাংলার মানুষ জীবন দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে আমাকে সেখান থেকে মুক্ত করে এনেছে। আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমাদের ভাবী বংশধরদের জন্য স্বাধীনতা দিয়ে যাব।’ সন্ধ্যায় নিজ বাসভবনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার করেছে যে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাই যদি সত্য হয় তবে জয়দেবপুরে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালাল কীভাবে? ঢাকায় অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে আমি এর জবাব চাই।’ অন্যদিকে ভুট্টোও এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমি এখন পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনের কোনো সুযোগ নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের হিস্সা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে আমিও চুপ করে থাকব না। আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখেছেন এবার পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখবেন।’ ভুট্টোর এ বক্তৃতায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। পরিষ্কার হয়ে যায় পাকিস্তান আলোচনা চালিয়ে গেলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে শাসনভার অর্পণেই তাদের আপত্তি। যেভাবেই হোক কেন্দ্র তারা দখলে রাখতে চায়। ভুট্টোর বক্তৃতার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত ছোট দলগুলো এবং স্বতন্ত্র সদস্যদের ৫৫ জন একত্রিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা সমর্থনদান ও ভুট্টোবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে কনভেনশন আহ্বান করেন।

সর্বশেষ খবর