বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

থমথমে বাঘাইছড়ি

লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর, তদন্ত কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক ও রাঙামাটি প্রতিনিধি

থমথমে বাঘাইছড়ি

স্বজনদের কান্না

বাঘাইছড়িজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ভয় ও আতঙ্কে আছেন দুর্গম জনপদ বাঘাইছড়ির নারী-পুরুষরা। দেওয়া হচ্ছে বাড়তি নিরাপত্তা। সোমবারের সেভেন মার্ডারের ঘটনার পর এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি ওই জনপদে। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার।

এদিকে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ যে সাতজন মারা গেছেন তাদের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। তবে ভয়ঙ্কর এই  হত্যাকাে র পর গতকাল রাত পর্যন্ত বাঘাইছড়ি থানায় কোনো মামলা হয়নি। আর আহতদের মধ্যে সাতজনকে গতকাল ঢাকায় সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়েছে। বাকিদের চট্টগ্রাম সিএমএইচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অন্য আহতদের বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে সোমবারের হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের চট্টগ্রাম অতিরিক্ত রেঞ্জের ডিআইজি, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক, সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ির রিজিওনের কমান্ডার ও রাঙামাটির পুলিশ সুপার গতকাল সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিল থেকে নিহতদের লাশ দাফনের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা গুলিবিদ্ধ আহতদের দেখতে গতকাল চট্টগ্রাম সিএমএইচে গিয়েছেন। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের বলেছেন, রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের নিরাপত্তার কোনো অভাব ছিল না। লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর : রাঙামাটি বাঘাইছড়ি থানার কর্মকর্তা এম এ মনঞ্জুর আলম জানিয়েছেন, বাঘাইছড়ির নয়মাইল বটতলা এলাকায় সোমবার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত সাতজনের লাশ গতকাল খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বিকালেই বাঘাইছড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। এদিকে নিহতদের লাশ গতকাল রাতে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে বাঘাইছড়ি থানার পুলিশ। এ সময় থানা প্রাঙ্গণে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। লাশ গ্রহণ করে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিহত সাতজনের লাশ দাফন ও সৎকারের জন্য তাদের পরিবারকে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের ত্রাণ তহবিল থেকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এদিকে গতকাল দিনভর নিহত সাতজনের বাড়িতে ছিল স্বজনদের কান্না আর আহাজারি। কেউ স্বামী হারিয়ে কেউবা সন্তান হারিয়ে আবার কেউ মাকে হারিয়ে শুধুই বিলাপ করছিলেন।

এখনো মামলা হয়নি : সেভেন মার্ডার নিয়ে গতকাল রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বাঘাইছড়ি থানায় কোনো মামলা হয়নি। নিহতদের স্বজনদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মামলা করতে যাননি কেউ। বাঘাইছড়ি থানা পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় কেউ মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। মামলার কাজ প্রক্রিয়াধীন। সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি : বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান। অতিরিক্ত সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক দীপক চক্রবর্তীকে কমিটির প্রধান ও রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সদস্য সচিব করে গঠন করা ওই কমিটিকে আগামী ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি, বিজিবি, পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি জেলা পরিষদ এবং আনসার-ভিডিপির প্রতিনিধি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন : বাঘাইছড়ি হত্যাকাে র ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গতকাল বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আবু ফয়েজ, সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিওনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. হামিদুল হক, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ ও রাঙামাটির পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির বাঘাইছড়ি উপজেলার নয়মাইল এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় খাগড়াছড়ি রিজিওনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. হামিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বাঘাইহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কংলাছড়ি  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি কেন্দ্রের মালামালসহ উপজেলা সদরে আসার পথে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্রাশফায়ার করে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের হত্যা করেছে। একই ঘটনায় আহত হয়েছে আরও ১৬ জন। এ ক্ষতি অপূরণীয়। এ ঘটনার জন্য স্থানীয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী অভিযানে নেমেছে। যতদিন পর্যন্ত পাহাড় থেকে এমন সশস্ত্র কর্মকা  বন্ধ না হবে, ততদিন পর্যন্ত পাহাড়ে সেনা অভিযান অব্যাহত থাকবে।

আহতরা ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিএমএইচে : বাঘাইছড়ির ঘটনায় আহতদের মধ্যে ছয়জনকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এরা হলেন- ফুলকুমারী, মো. জাফর মিজান, নিরু বিকাশ, সাদ্দাম, মাহাবুব ও মামুন। অপরদিকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আবদুল হান্নান (৩০), মো. বদিউল আলম (৪৭), পোলিং কর্মকর্তা সোহেল চাকমা (৩৫) ও কাঞ্চন দে (৩০), পুলিশ কর্মকর্তা মো. মাহামুদুল আলম (৪৭), পুলিশ সদস্য বিল্লাল হোসেন, মো. আলিম হোসেন, রবিউল ইসলাম ও আনসার ভিডিপি সদস্য মো. জাফর আলী। তাদের সুস্থ করে তুলতে সব ধরনের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন পুলিশের এস আই মো. রজব আলী ও ইউসুফ। আর চারজন চিকিৎসা নিচ্ছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা স্থাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এদিকে রাঙামাটি বাঘাইছড়ি ও বিলাইছড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে হতাহতের ঘটনার জন্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমার সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করে আজ বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ।

হাসপাতালে সিইসি : প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এম নূরুল হুদা বলেছেন, নির্বাচনের অনিয়মের প্রতিশোধ মানুষের জীবন নিয়ে নয়। নির্বাচনে যারা হেরে যায় তাদের নানা অভিযোগ থাকে। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে আহতদের দেখতে গিয়ে এসব কথা বলেন সিইসি। প্রসঙ্গত, সোমবার উপজেলা নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে যাওয়ার পথে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ সাতজন মারা যান।

খাগড়াছড়িতে আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল : নির্বাচনী কর্মকর্তা ও বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে হত্যার প্রতিবাদে আজ খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে পার্বত্য বাঙ্গালি ছাত্র পরিষদ। গতকাল সন্ধ্যায় সংগঠনটির খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. রবিউল হোসেন স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বাঙ্গালি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি মো. লোকমান হোসেন হরতালের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর