সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘ওয়াসিম হত্যার বিচার চাই’

এবার সিলেটে সড়ক-হত্যা, ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল রাজপথ, চালক-হেলপার রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

‘ওয়াসিম হত্যার বিচার চাই’

নিহত ওয়াসিম। সিলেটে গতকাল সহপাঠীদের বিক্ষোভ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এবার সিলেটে সড়কে হত্যায় ছাত্রবিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে সিলেটের রাজপথ। ‘ওয়াসিম হত্যার বিচার চাই’, ‘সান্ত্বনা নয়, ফাঁসি চাই’, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এমন স্লোগানে গতকাল প্রকম্পিত ছিল সিলেট নগরীর ব্যস্ততম চৌহাট্টা পয়েন্ট। বাসচাপা দিয়ে ছাত্র ‘হত্যা’র প্রতিবাদের আন্দোলনে এভাবেই কেঁপে ওঠে সিলেটের রাজপথ। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধে আটকে যায় সাবেক অর্থমন্ত্রীর গাড়িও। পরে পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে অবরোধ তুলে নেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে সিকৃবি শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া সেই বাসটির চালক ও হেলপারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে জেলহাজতে। এর আগে গ্রেফতারের পর ওই চালক ও হেলপার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

শনিবার বিকালে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের শেরপুরে উদার পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ভ-১৪-১২৮০) সিকৃবির বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ঘোরি মো. ওয়াসিম আব্বাসকে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দিয়ে হত্যা করে’ বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ভাড়া নিয়ে বাগ্বিতন্ডার জেরে ওয়াসিমকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন হেলপার। পরে চালক দ্রুত বাসটি ওয়াসিমের ওপর দিয়েই চালিয়ে দেন। গুরুতর আহত ওয়াসিমকে ওসমানী হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় শনিবার রাতেই বিক্ষোভ করেন সিকৃবির শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কদমতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে কয়েকটি বাস ভাঙচুর করে তারা। সাংবাদিকদের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড এসে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নেন।

সড়ক অবরোধ : ওয়াসিম ‘হত্যা’র প্রতিবাদে গতকাল বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ১২টার দিকে নগরীর চৌহাট্টা পয়েন্টে এসে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীরা তখন সড়ক অবরোধ করেন। ‘আমার ভাই মরল কেন, জবাব চাই’, ‘ওয়াসিম হত্যার বিচার চাই’ ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ প্রভৃতি স্লোগানে রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অবরোধে চৌহাট্টা-রিকাবীবাজার, চৌহাট্টা-আম্বরখানা, চৌহাট্টা-নয়াসড়ক ও চৌহাট্টা-জিন্দাবাজার সড়কে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে, তৈরি হয় দীর্ঘ যানজটের। ভোগান্তি পোহান সাধারণ মানুষ।

আটকে গেল সাবেক অর্থমন্ত্রীর গাড়ি : সিকৃবির শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের মধ্যে ওই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সাবেক এমপি আবুল মাল আবদুল মুহিত। শিক্ষার্থীরা তার গাড়িও আটকে দেন। তখন মুহিতের সঙ্গে থাকা সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও সহ-সভাপতি আশফাক আহমদ গাড়ি থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মুহিতের গাড়ি ছাড়তে রাজি হননি।

সংহতি জানালেন মুহিত : চৌহাট্টায় সড়ক অবরোধে আটকা পড়ার পর গাড়ি থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। মুহিত বলেন, ‘গতকালের (শনিবার) হত্যাকান্ডটি আমার মতে একটি পরিষ্কার হত্যাকান্ড।’ শিক্ষার্থীরা পেল সিসিকের পানি : ছাত্র ‘হত্যা’র প্রতিবাদে সিকৃবির শিক্ষার্থীরা যখন নগরীর চৌহাট্টায় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছিলেন, তখন সেখানে এসে হাজির হয় সিলেট সিটি করপোরেশনের পানিবাহী একটি ট্যাঙ্ক। প্রখর রোদে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীরা সিসিকের এই পানি পান করেন। তবে এই পানি সরবরাহের বিষয়টি সিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (পানি শাখা) আলী আকবর ‘জানেন না’ বলে মন্তব্য করেছেন।

ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন : সিকৃবির শিক্ষার্থীরা গতকাল সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে নামেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আগামী তিন দিনও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল তাদের ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যেও এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবি : ওয়াসিম আব্বাস ‘হত্যা’র প্রতিবাদে আন্দোলনরত সিকৃবির শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবির মধ্যে আছে, অভিযুক্ত চালক ও হেলপারের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করা, উদার পরিবহনের রোড পারমিট ও লাইসেন্স বাতিল করা, লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়কে চলতে না দেওয়া, অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি না চালানো এবং সড়কে শিক্ষার্থীসহ সব যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গতকাল বেলা ২টার দিকে এসব দাবি জানিয়ে সড়ক অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

সিকৃবি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মানববন্ধন : শিক্ষার্থীকে বাসচাপায় ‘হত্যা’র প্রতিবাদে গতকাল বেলা ১১টায় মানববন্ধন করেছেন সিকৃবির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এ ছাড়া ওয়াসিম স্মরণে শোকসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নূর হোসেন মিঞার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জীতেন্দ্র নাথ অধিকারীর সঞ্চালনায় শোকসভায় বক্তব্য রাখেন সিকৃবির ভিসি অধ্যাপক ড. মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদার, ডিন কাউন্সিলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল ইসলাম শোয়েব প্রমুখ।

সেই চালক ও হেলপার গ্রেফতার : সিকৃবির শিক্ষার্থী ওয়াসিম আব্বাসকে চাপা দেওয়া উদার পরিবহনের সেই বাসের চালক জুয়েল আহমদ (২৬) ও হেলপার মাশুক আলীকে আটক করেছে পুলিশ। জুয়েল মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার মৃত আজিদ মিয়ার ছেলে। অন্যদিকে মাশুক সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া এলাকার দৌলত আলীর ছেলে। শনিবার রাত ১১টার দিকে কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে জুয়েলকে আটক করা হয়। এ ছাড়া রাত ২টার দিকে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সিংচাপইড় গ্রামে শ্বশুরবাড়ি থেকে আটক করা হয় মাশুককে। আটক চালক ও হেলপারকে ঘটনাস্থল মৌলভীবাজার সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন মৌলভীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুহেল আহমদ।

চালক ও হেলপারের স্বীকারোক্তি : সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) শিক্ষার্থী ওয়াসিম আব্বাস ঘুড়িকে বাসচাপায় হত্যার অভিযোগে উদার পরিবহনের চালক জুয়েল আহমদ ও হেলপার মাশুক মিয়াকে আটক করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার বিষয়ে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। নিহত ওয়াসিম হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার রুদ্রগ্রাম এলাকার মাহবুব ঘুড়ির ছেলে। তিনি সিকৃবির মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বীকারোক্তিতে তারা বলেন, শনিবার নবীগঞ্জের টোলপ্লাজা থেকে সিলেট যাওয়ার উদ্দেশে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র উদার পরিবহনের বাসে ওঠেন। এ সময় হেলপার মাশুক মিয়া তাদের কাছে ১০০ টাকা ভাড়া দাবি করেন। এতে ওয়াসিম ও তার বন্ধুরা ছাত্র পরিচয় দিয়ে ভাড়া কম দেওয়ার কথা জানান। এতে হেলপার ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের সঙ্গে বাগ্বিতন্ডায় জড়ান। একপর্যায়ে তারা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে নেমে যান। নামার সময় পেছন থেকে হেলপার তাদের গালি দেন। এতে ওয়াসিম বাসের সিঁড়িতে উঠে হাতলে ধরে কেন গালি দিলেন তা জিজ্ঞেস করছিলেন হেলপারকে। এ সময় চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। ঠিক তখনই ওয়াসিমকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন হেলপার মাশুক মিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বাসের পেছনের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে ওয়াসিম গুরুতর আহত হন। পরে তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে গতকাল দুপুরে ওয়াসিমের মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার রুদ্রগ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের মাতম চলছে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তার মা-বাবা।

আন্দোলনে ছয় শিক্ষার্থী অজ্ঞান : ওয়াসিম আব্বাস ‘হত্যার’ ঘটনায় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের গতকালের আন্দোলনে অজ্ঞান হয়ে পড়েন ছয় শিক্ষার্থী। প্রখর রোদের মধ্যে থাকায় তারা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এই ছয় শিক্ষার্থী হলেন- সীমা দেবনাথ, ইমরানা রাত্রি, মাদিহা বিনতে মহিউদ্দিন, তামান্না তাবাসসুম, ফাতেমা-তুজ-জোহরা ও তাবাসসুম মেহজাবিন।

সিকৃবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি উত্তম কুমার দাশ জানান, অজ্ঞান হওয়া শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ওসমানী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। খবর পেয়ে হাসপাতালে যান সিকৃবির প্রক্টর অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড।

সর্বশেষ খবর