সোমবার, ২৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

চালক-হেলপার ঔদ্ধত্য থামছেই না

সাইদুর রহমান রিমন

যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাস দৈনিক ভিত্তিতে ‘ইজারা’ নিয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠছেন চালক-হেলপাররা। কোনোভাবেই থামছে না তাদের ঔদ্ধত্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাস্তায় নামলে দৈনিক চাঁদা, পুলিশের বখরা, মাস্তান ভাতাসহ মালিকের টাকা মিলিয়ে অন্তত ছয় হাজার টাকা পরিশোধের পরই কেবল চালক-হেলপাররা নিজেদের বেতন-ভাতা পকেটে নিতে পারেন। খরচের তালিকায় রয়েছে মালিক সমিতির নামে দৈনিক ১১০০ টাকা, মোবাইল কোর্ট বন্ধের নামে ৫০০ টাকা, শ্রমিকদের নানা সংগঠনের নামে ৫০০ টাকা এবং চালক, কন্টাক্টর, হেলপারের বেতন-ভাতাসহ রুট খরচ, পার্কিং বখরা, টার্মিনাল খরচ, মাস্তান ভাতা। এ ছাড়া পুলিশ বখরা তো আছেই। গাড়ির মালিক প্রতিদিন তিন-চার হাজার টাকার বিনিময়ে গাড়ি দেন চালককে। সেই চালক ভোর ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গাড়ি চালান নিজে অথবা হেলপারকে দিয়ে। গাড়ি থেকে যা আয় হয় তা চালক পান। অতিরিক্ত আয়ের হাইপারটেনশনের মধ্যে চালকরা চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতেও পিছপা হন না। এ কারণেই মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং একই রুটে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসকে পেছনে ফেলতে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর অপকর্মে মেতে ওঠেন চালকরা। প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর মাধ্যমে যাত্রীদের জীবন বিপন্ন করে তোলার অপরাধে কোনো চালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। রাস্তার মাঝ বরাবর গাড়ি থামিয়ে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ঘটনাতেও শাস্তি দেওয়া যায়নি কোনো চালককে। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে বড়জোর নামকাওয়াস্তে জরিমানা করা হয়। সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টির নানা অপরাধ করেও চালকরা শাস্তিমুক্ত থাকায় দিন দিনই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এসব কারণে সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলার জঞ্জাল লেগেই থাকে। ট্রাফিক বিভাগ ও হাইওয়ে পুলিশ ‘সড়কের বিশৃঙ্খলা’-কে ‘যানজট’ দোহাই দিয়ে ব্যর্থতা চাপা দেওয়ার কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন।

যেখানে ট্রাফিক সেখানেই যানজট : সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট পরিদর্শনকালে দেখা যায়, যেসব স্থানে ট্রাফিক ও সার্জেন্টরা ডিউটিতে ব্যস্ত, তাদের চারপাশেই ভয়ঙ্কর যানজট গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে টার্গেটকৃত গাড়িগুলো থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষার নামে বখড়াবাজিকেই দায়ী বলে মনে করেন ভুক্তভোগী চালকরা। তারা জানান, মধ্য রাস্তায় এসব বখড়াবাজির লেনদেন, দরকষাকষির ঘটনাতেই ট্রাফিক পয়েন্টসমূহে যানজটের সূত্রপাত ঘটে। এদিকে রাজধানীতে মধ্যরাতেও ভয়াবহ যানজট সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী জানা গেছে। রাত ১০টার পর থেকেই ব্যস্ততম বিভিন্ন সড়কের সিংহভাগ অংশ বাস-মিনিবাসের পার্কিংস্থল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের মাস্তান-সন্ত্রাসীরা এসব সড়ক ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাত ৯টার পর মহাখালী টার্মিনাল থেকে মহাখালী মোড় পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে তিন সারিতে শত শত কোচ পার্ক করে রাখা হয়। ফাঁকা রাখা সামান্য একচিলতে রাস্তা দিয়ে প্রাইভেটকার-মাইক্রো যাতায়াতও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অবৈধ পার্কিং বাণিজ্যের কারণে বঙ্গবাজারের সামনে থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ফুলবাড়িয়ার প্রশস্ত রাস্তাটি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। স্থানটি মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কাপাসিয়া, কালিগঞ্জ, সাভার-ধামরাইসহ ৩০টি রুটের শত শত বাস-মিনিবাসের স্থায়ী টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। ফলে গোটা সড়কটি টার্মিনাল, না স্ট্যান্ড, নাকি হাটবাজার তা ঠাহর করা মুশকিল। একইভাবে মিরপুর-১১ থেকে ১২ পর্যন্ত, কালশী সড়ক, মিরপুর মাজার রোড, চিড়িয়াখানা রোড, যাত্রাবাড়ী থেকে শনিরআখড়া, মোহাম্মদপুর টাউন হল থেকে ধানমন্ডি আবাহনী মাঠ, আজিমপুর মোড়ের চারপাশের রোডগুলো, টিকাটুলী রাজধানী মার্কেট থেকে সায়েদাবাদ ব্রিজ, রিং রোড থেকে মেরুল বাড্ডা, মালিবাগ বাজার মোড় থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভার, কমলাপুর স্টেশন থেকে পীরজঙ্গি মাজার পর্যন্ত এলাকা বিভিন্ন রুটের বাস-মিনিবাসের স্থায়ী টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। পুরান ঢাকার প্রধান সড়ক নর্থ-সাউথ রোডের অর্ধেকটা অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ওই সড়কের বেশির ভাগ অংশই সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মালামাল রাখা ও লোড-আনলোডের পয়েন্টে পরিণত হয়ে আছে। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ডিজিটাল সিগন্যালিং ব্যবস্থা গড়ে তুললেও ট্রাফিক কর্মকর্তারাই সেসব সিগন্যাল ব্যবস্থা অচল করে ফেলে রাখছেন। রাস্তায় দাঁড়ানো ট্রাফিক কর্মকর্তারা লাল-সবুজ সংকেতের ভ্রুক্ষেপও করেন না। তারা ইচ্ছামাফিক গাড়ি ছাড়েন, ইচ্ছামাফিক বন্ধ রাখেন। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশমুখের ব্যস্ততম মোড়ে লাল-সবুজের ইলেকট্রিক্যাল সংকেত-বাতির সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশও লাঠি-বাঁশি হাতে সদা তৎপর থাকেন। এর পরও রশি টেনে রাস্তা পারাপারকারী পথচারীদের আটকে রাখার ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন তারা। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হয়ে যাতায়াতকারী শত শত বিদেশি নাগরিকও এ দৃশ্য উপভোগ করেন। তারা ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ড করে নিয়ে যান। এসব দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যকর দৃশ্য হিসেবে উপস্থাপিত হলেও সড়কের এই নৈরাজ্য চিত্র দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।

সর্বশেষ খবর