মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিল্পবিপ্লব ঘটাতে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল

রুহুল আমিন রাসেল

শিল্প খাতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে রীতিমতো শিল্প বিপ্লব ঘটবে। বদলে যাবে দেশের অর্থনীতির চেহারা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে কোটি মানুষের। এই সম্ভাবনার পুরোটাই হচ্ছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে। বাড়তি ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি আয় করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে গড়ে উঠছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। আছে বিদেশিদের জন্য বিশেষ অঞ্চল। বিদেশিদের মধ্যে ভারত, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, হংকং, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ বিনিয়োগ করবে শত শত বিলিয়ন ডলার। এসব দেশের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৮৮টি অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এসব এলাকায় কাজও চলছে। এর মধ্যে  বেসরকারি খাতের ৮টি অঞ্চল উৎপাদনেও এসেছে। আর সরকারি তিনটি অঞ্চল উৎপাদনে আসার অপেক্ষায়। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। এসব তথ্য জানা গেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে। জানা গেছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগে সবচেয়ে এগিয়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। আছে কেমিক্যাল ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) খাত এবং স্টিল, অটোমোবাইলস, পেইন্টসহ বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগও। এসব খাতের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে। সরকারি খাতের এই শিল্পনগরে ইতিমধ্যে দুই হাজার ৮৭৪ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। এরপরই রয়েছে মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল। সরকারি এই প্রকল্পে বিনিয়োগ এসেছে দুই হাজার ৪৮৯ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর বেসরকারি খাতের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে ২৭১ দশমিক ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সবচেয়ে বিনিয়োগ এসেছে মৌলভীবাজার শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে। মাত্র ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ৪৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে। এ ছাড়া ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এগিয়ে চলছে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ। নাফ ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। বেজার তথ্যানুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে তোলা হবে। এতে কর্মসংস্থান হবে কোটি মানুষের। বেজার সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ১০০টি অঞ্চলের মধ্যে ৮৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান চূড়ান্ত হয়েছে। এসব অঞ্চলে আগামী দুই বছরে ১ লাখ একর জমির ‘বিশাল ব্যাংক’ তৈরি করা হবে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের ৮টি জোন উৎপাদনে এসেছে। ইতিমধ্যে ৩০ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও একটি অঞ্চল উৎপাদনে আসার প্রক্রিয়া চলছে। এতে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। চীনের কুনমিং আয়রন অ্যান্ড স্টিল মিলস করপোরেশন লিমিটেড আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করবে। আরও আগে ৫ বিলিয়নের একটি প্রকল্প প্রস্তাব এসেছে। তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জে জাপানের জন্য একটি এক্সক্লুসিভ জোন স্থাপনে জমি উন্নয়নের কাজ চলছে। চীনের জোন উন্নয়নের কাজ চলছে। ভারতীয় জোনের কাজে হাত দিয়েছি। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব- পিপিপিতে মোংলা জোন প্রস্তুত আছে। শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে মহেশখালীতে। জাপানের জন্য নতুন আরেকটি জোন করছি। পদ্মা সেতুর শরীয়তপুর অংশে একটি জোনের সম্ভাবনা আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। বেসরকারি খাতে নতুন মূলধন সৃষ্টির হার বাড়াতে চায় সরকার। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বিনিয়োগের হার মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে চায় সরকার। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন কৌশলের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। বেজা সূত্রে জানা গেছে, শিল্প বিপ্লবে জমির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। এ পর্যন্ত ৮৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বর্তমানে ১৪টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চলছে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে কর অবকাশসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। ফলে প্রতিদিনই বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে। বেজা জানিয়েছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে চীন, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, হংকং, সৌদি আরবসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে এবং আরও আসছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনÑএফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগের সবচেয়ে উত্তম পরিবেশ। এমন পরিবেশ পেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ ব্যবসা স্থানান্তর করতে চান বিদেশিরা। বাংলাদেশও প্রস্তুত বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণে। এর সঙ্গে দেশি বিনিয়োগকারীদেরও সক্ষমতা বাড়ছে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য আশার আলো হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী দিনের বাংলাদেশ হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা। এটা বিদেশিরা যেমন বুঝতে পেরেছেন, তেমনি দেশীয় ব্যবসায়ীরাও অনুধাবন করেছেন। ফলে বিনিয়োগ আসছে। আরও আসবে। কারণ আমাদের রয়েছে বিশাল মানবসম্পদ। ফলে আগামীতে যে শিল্প বিপ্লব বাংলাদেশে হতে যাচ্ছে, সেজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এখনি নিতে হবে। জানা গেছে, বেজা ইতিমধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে প্রি-কোয়ালিফিকেশন পত্র ও ৭টির অনুকূলে লাইসেন্স প্রদান করেছে। চীন, জাপান, ভারত ও মালয়েশিয়াসহ বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য আলাদা আলাদা শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের দুর্ভোগ লাঘবেও চালু করা হচ্ছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস। যেন একই ছাতার নিচ থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের সেবা পান দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে প্রণোদনা ও সুবিধা : অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১৫ বছর মেয়াদি কর অবকাশ সুবিধা দেবে সরকার। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর শতভাগ কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে। বিদ্যুৎ বিলের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হবে না ১০ বছর। পেট্রোলিয়াম পণ্য ছাড়া সব প্রকার ক্রয়ে ভ্যাট অব্যাহতির সুযোগ থাকবে। লাগবে না শুল্ককর। থাকছে স্ট্যাম্পকর মওকুফসহ আরও সুবিধা। বিনিয়োগে প্রণোদনা ও সুবিধা : অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন হারে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পাবে। শূন্য শুল্কে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, নির্মাণসামগ্রী আমদানির সুবিধা রয়েছে। উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী দেশীয় বাজারে বিক্রি করা যাবে। রপ্তানিতে শুল্ককর দিতে হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শুল্ক ছাড়াই দুটি গাড়ি আমদানির সুবিধা পাবেন। থাকবে কাস্টমস বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা। যৌথ বিনিয়োগে শিল্প স্থাপন করা যাবে।

অংশীদারিত্ব বা মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে। শিল্পের মোট জনবলের ৫ শতাংশ বিদেশিকে ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হবে। থাকবে পুনঃবিনিয়োগ সুবিধা। বিনিয়োগকারীরা ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে রেসিডেন্ট ভিসা পাবেন এবং ৫ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব।

সর্বশেষ খবর