বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়

মহান স্বাধীনতা দিবসে বীর সন্তানদের স্মরণ

সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়

স্বাধীনতার ৪৮তম বার্ষিকীতে বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে গতকাল দেশ-মাতৃকার বীর সন্তানদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করল জাতি। শ্রদ্ধা নিবেদনের মূল কেন্দ্র ছিল সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্ণ করা বাংলাদেশ এবার দিবসটি ভিন্ন আঙ্গিকে পালন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসা বাংলাদেশ সামাজিক-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জয়ী হবে- এই আকাক্সক্ষা ছিল স্মৃতিসৌধে আসা সবার চেতনায়।

গতকাল ভোর থেকেই লাল-সবুজের পতাকা আর ফুল হাতে জনস্রোত ছুটে চলেছে স্মৃতিসৌধের দিকে। তাদের পোশাকেও প্রাধান্য পেয়েছে জাতীয় পতাকার রং। বাতাসে ভেসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারি গান আর বঙ্গবন্ধুর দরাজ কণ্ঠের ভাষণ। বর্ণিল শোভাযাত্রায় কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে ছিল ‘জয় বাংলা’র স্লোগান আর স্বাধীনতার গান। এমনকি অনেকের গালে-কপালে স্থান পেয়েছে রংতুলিতে আঁকা জাতীয় পতাকা। একই সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে যাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বীর যোদ্ধাদের। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের।

মহান স্বাধীনতা দিবসের ভোর ৬টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল তাঁদের গার্ড অব অনার দেয়। এ সময় তারা দাঁড়িয়ে কিছু সময় নীরবতা পালন করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট স ম রেজাউল করিম, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রমুখ।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাসহ কমিশনারবৃন্দ ’৭১-এর বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যাওয়ার পর সকাল ৭টায় স্মৃতিসৌধ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ফুল দিয়ে মহান বীরদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা  জানান। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে তরুণ যুবক, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, কূটনীতিক, সমাজকর্মীসহ লাখো মানুষ জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে মহান বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তাদের পুষ্পাঞ্জলিতে ঢেকে যায় বেদি।

বিএনপির শ্রদ্ধা নিবেদন : সকাল ৯টায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান। এ ছাড়া নজরুল ইসলাম খান, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, শামা ওবায়েদ, দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবুসহ বিএনপি নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তিই স্বাধীনতা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার। তিনি বলেন, আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, যে চেতনা ও আদর্শকে সামনে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, আজকে সে চেতনা ও আদর্শ সম্পূর্ণভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটা চক্রান্ত প্রায় প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চলেছে।

সকাল ১০টার দিকে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন সংগঠনটির ব্যানারে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে আসেন। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আন্দোলনের মধ্যে আমরা আছি। ষোলআনা মুক্তির জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

দুপুর ১২টা পর্যন্ত যেসব সংগঠন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদ করে তারা হলো- জিএস গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ফজিলাতুন নেসা হল জাবি, পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শহীদ সালাম বরকত হল জাবি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট জাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, ঢাকা জেলা পুলিশ, বাংলাদেশ পুলিশ, জাকের পার্টি, জাকের পার্টি ছাত্রীফ্রন্ট, শহীদুল্লাহ হল ঢাবি, জাকের পার্টি যুবফ্রন্ট, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, জিয়াউর রহমান হল, ঢাবি, জাকের পার্টি ছাত্রফ্রন্ট, পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ প্রাক্তন সৈনিক সংস্থা, স্যার এ এফ রহমান হল ঢাবি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সজাগ (সমাজ ও জাতি গঠন), জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাবি শিক্ষক সমিতি, সড়ক ও জনপথ প্রকৌশল সমিতি, মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল ঢাবি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জবি শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, কবি জসীমউদ্দীন হল ঢাবি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন, এডাব, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ কংগ্রেস, জাসদ, ঢাকা জেলা বিএনপি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলী সমিতি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন পরিষদ, মৎস্য অধিদফতর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাপ, জাবি ছাত্রলীগ, জাবি সাংবাদিক সমিতি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ আইন সমিতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী লীগ, বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি, নাগরিক ঐক্য, বাসদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, টেক্সটাইল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স পার্টি, ঢাকা আইনজীবী সমিতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, গণফোরাম,  বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, বাউবি ছাত্র ঐক্য পরিষদ, ঢাকা ট্যাকসেস বার অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ইত্যাদি।

নানা আয়োজনে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন : জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে গতকাল মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন হয়েছে। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি পালন করা হয়।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকালে মসজিদে কোরআন-খানি, দোয়া ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। সরকারি হাসপাতাল, কারাগার, শিশুসদন, এতিমখানাগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।

সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে স্বাধীনতা দিবসের শিশু কিশোর কুচকাওয়াজ, প্যারেড ও ডিসপ্লে পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি কুচকাওয়াজের অভিবাদন গ্রহণ করেন।

দিবসটি উপলক্ষে স্মারক ডাক টিকিট অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে গতকাল দিনভর ছিল দলীয় নেতা-কর্মী ও ভক্ত শুভার্থীদের ভিড়। তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। বাংলাদেশ সোনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী তাদের যুদ্ধ জাহাজ ও সামরিক সরঞ্জাম সর্বসাধারণের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনভর আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

সর্বশেষ খবর