শিরোনাম
শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগে ১০ বছরে ৪০০ ভুঁইফোড় সংগঠন

রফিকুল ইসলাম রনি

আওয়ামী লীগে ১০ বছরে ৪০০ ভুঁইফোড় সংগঠন

‘বাংলাদেশ ইলেকট্রিক লীগ-গাজীপুর মহানগর’ নম্বর প্লেটবিহীন  মোটরসাইকেলের পেছনে লেখা এমন একটি ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম লিখেছেন ‘কে কে নাম লিখাতে চান এই দোকানের?’ আলহাজ সরদার সোহেল আহমেদ নামে একজন কমেন্ট লিখেছে, ‘আমার গাজীপুরের কমিটি এটা, ভাঙাচোরা লীগও আছে।’ মজার ব্যাপার হলো, গাজীপুরের অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ওইসব ব্যানারে অতিথি হয়ে ভাঙাচোরা বক্তৃতা করেন। সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি সাবিনা আকতার তুহিন কমেন্ট করেছেন, কত যে দোকান খুলবে? গাছের পাতাও বলে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এটা কি সত্যি নাকি মুখোশ পরে আওয়ামী লীগের বদনাম করতে অনুপ্রবেশ পেয়েছে? শুধু ‘বাংলাদেশ ইলেকট্রিক লীগ’ নয়, ‘নাপিত লীগ’, ‘ফকির লীগ’ ‘জননেত্রী লীগ’, ‘প্রবীণ লীগ’ ‘ডিজিটাল লীগ’ নাগরিক লীগ’সহ নিত্যনতুন লীগ গড়ে উঠছে।  আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের ১০ বছর ৩ মাসে কমপক্ষে ৪শ ভুঁইফোড় সংগঠনের জন্ম হয়েছে। কিছু সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৯৬ সালের প্রথম ক্ষমতায় আসার পর। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের চরম দুর্দিনে তাদের দেখা যায়নি। তখন তাদের অনেকেই নিজেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে পরিচয়ই দিতেন না। কেউ কেউ বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই মাটি ফুঁড়ে সংগঠন গজানোর হিড়িক পড়ে যায়। প্রতিদিনই জন্ম নেয় নিত্যনতুন লীগ। যার নেই কোনো গঠনতন্ত্র, কার্যালয়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এসব সংগঠনের নেতারা নিজেদের ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বা কখনো কখনো সমর্থক সংগঠন বলে পরিচয় দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় কোনো অনুমোদন না থাকলেও এসব সংগঠনের নেতারা চাঁদাবাজি, তদবিরবাজি ও প্রভাব বিস্তার, লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, ব্যানার-ফেস্টুন, পোস্টার ছাপিয়ে ব্যক্তি প্রচারণায় মেতে ওঠেন। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে এই সংগঠনের কথিত নেতাদের দাপটে মূল দলের নেতা-কর্মীরাও অতিষ্ঠ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো দল ক্ষমতায় এলেই সেই দলের ভিতরে বা বাইরের ব্যক্তি দলের নাম ভাঙিয়ে স্বার্থ হাসিলে উঠেপড়ে লাগে। গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, মূল দলের সঙ্গে মিল রেখে নানা সংগঠন খুলে চাঁদাবাজি বা সরকারি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে এরা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ‘জাতীয়তাবাদী’ বা ‘জিয়া’ তকমা লাগিয়ে গজিয়ে ওঠে এসব সংগঠন। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘আওয়ামী’ শব্দ ব্যবহার করে গঠন করা হয় নানা সংগঠন। জানা গেছে, এসব ভুঁইফোড় সংগঠন গজিয়ে উঠতে সুযোগ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কিছু নেতা, বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রী। তাদের ‘রাজনৈতিক বেকারত্ব’ কাটাতে দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণে বা বিরোধী পক্ষকে কটাক্ষ করতে ‘শব্দবোমা’ ফাটাতেই এসব ভুঁইফোড় সংগঠনকে প্রথমে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের কেউ কেউ মিডিয়ার ‘খোরাক’ দিতে চটকদার কথার পাশাপাশি দল ও সরকারের বিরুদ্ধেও কথা বলতেন। আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে কেন্দ্রের কয়েকজন নেতা এসব ‘দোকানে’ সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। ওই সময়ে এসব নেতার মুখ বন্ধ করতে কয়েকজনকে মন্ত্রিত্বও দেওয়া হয়েছিল। আবার কয়েকজন নেতা সক্রিয় হয়েছেন। কেউ মন্ত্রিত্ব পাননি, আবার কেউ কেউ মন্ত্রিসভায় আছেন। মূলত রাজনীতির যেসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা সেমিনারের আয়োজন করে এসব সংগঠনের উদ্যোক্তারা।  জানা গেছে, ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতারা তদবির করে মন্ত্রী-এমপিদের কাছ থেকে সুবিধা বাগানো, বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতিয়ে নেওয়া, পদক বাণিজ্য, চাকরিতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে তদবির করাসহ অসংখ্য কাজে লিপ্ত। এদের কেউ কেউ গোড়ার দিকে ঢাকা শহরে মেসে বাস করলেও কালক্রমে ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে তুলে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। তারা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা, সহযোগী সংগঠনের নেতা পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়ান সচিবালয়সহ বিভিন্ন অফিস-আদালত। অপরদিকে রাজধানীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান শেষে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে তারা এলাকায় গিয়ে বিশাল বিশাল পোস্টার সাঁটিয়ে কেন্দ্রীয় নেতার পরিচয় দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ স্থানীয় অফিস-আদালতের টেন্ডারসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশে অনেকেই আওয়ামী লীগের নাম মুখে নিতে চায়নি। সে সময়ে সংগঠন হিসেবে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু পরিষদ এবং আমরা সূর্যমুখীসহ হাতে গোনা ৪-৫টি সংগঠন ছিল যারা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে সে সময়ে দেশের প্রখ্যাত শিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও নির্মাতারা মানববন্ধন, মোমবাতি প্রজ্বালন করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার দাবি করেছেন। রাজাকারের বিচার দাবি করেছেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব সংগঠন বাড়তে থাকে। গত দুই মেয়াদে বাড়ার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। দলীয় ও সরকারি বৈধ কোনো অনুমোদন না থাকলেও এ সংগঠনের নেতাদের দৌরাত্ম্য এতই বেড়ে চলেছে যে, দলীয় অনেক নেতাকে পর্যন্ত তারা তোয়াক্কা করেন না। বিষয়টি আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এসব নামসর্বস্ব সংগঠন বাড়ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জানা গেছে, গত দশ বছরে জন্ম নেওয়া অধিকাংশ সংগঠনের মধ্যে রয়েছেÑ পর্যটন লীগ, তরিকত লীগ, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক লীগ, নাপিত লীগ, ফকির লীগ, জননেত্রী লীগ, প্রবীণ লীগ, ডিজিটাল লীগ, আওয়ামী অভিভাবক লীগ, দর্জি লীগ, তরুণ লীগ, রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, যুব হকার্স লীগ, নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, ছিন্নমূল হকার্স লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, তৃণমূল লীগ, স্বাধীনতা লীগ, হোটেল শ্রমিক লীগ, হকার্স লীগ, চালক লীগ, প্রচার ও প্রকাশনা লীগ, বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, মোটরচালক লীগ, সমবায় লীগ, হারবাল লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, পরিবহন শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু হোমিওপ্যাথি লীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক লীগ, জননেত্রী চিন্তা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্মচারী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, আমরা মুজিব সেনা, আমরা মুজিব হবো, চেতনায় মুজিব,  বঙ্গবন্ধুর সৈনিক লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ঠিকানা বাংলাদেশ ৫১, জনতার প্রত্যাশা, রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি, দেশরত্ন পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পরিষদ, আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোটসহ চার শতাধিক সংগঠন। জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি-ডিআরইউ, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসহ বিভিন্ন স্থানে এসব সংগঠনের মানববন্ধন, আলোচনা অনুষ্ঠানে নিয়মিতই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশ নিতে দেখা যায়। এমনকি দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে এ সংগঠনগুলো ব্যানার নিয়েই হাজির হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিদের সম্মাননা প্রদান, আর দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয়ের সঙ্গে ছবি তুলে পোস্টারে, ফেসবুকে প্রচারণা চালাতেও দেখা যায় কোনো কোনো সংগঠনের নেতাদের। শুধুু ঢাকা শহরেই নয়, এ রকম ভুঁইফোড় সংগঠন রয়েছে তৃণমূল পর্যায়েও। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি, থানার দালালি, এলাকার নিরীহ ব্যক্তিদের নানা ধরনের হয়রানি করার অভিযোগ। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় খাইরুল সিকদার নামে একজন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার স্থাপন করেন। তিনি সংগঠনটির উপজেলা শাখার স্বঘোষিত সভাপতি। কেন্দ্রীয় এমন কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।  এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব সংগঠন আওয়ামী লীগের অনুমোদিত নয়। নামের আগে লীগ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দ জুড়লেই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হবে না। আওয়ামী লীগের ছয়টি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন আছে। এ ছাড়া যারাই সহযোগী সংগঠন হিসেবে পরিচয় দেবে তারা সঠিক কাজটি করছেন না। কেউ প্রতারণা ও চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভুঁইফোড় সংগঠন সম্পর্কে আমরা অনেক আগেই দেশবাসীকে সতর্ক করেছিলাম। এদের কোনো স্বীকৃতি নেই। যারা লীগ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দ ব্যবহার করে সংগঠন করছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাব। আগামী কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি তোলা হবে। এ ছাড়াও তিনি ভুয়া সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আহ্বান জানান।

সর্বশেষ খবর