মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘দিদি’র দুর্গে ভাগ চান মোদি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

বাংলা ও উড়িষ্যা জয় করতে পারলেই তাদের জয়ের বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে- একাধিকবার এ কথা বলতে শোনা গেছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর মুখে। আর সে পথেই অর্থাৎ বিধানসভার ভোটকে লক্ষ্য করেই হাঁটছে তারা। তবে তার আগে  লোকসভায় ভালো ফল করতে চায় গেরুরা শিবির। তাদের লক্ষ্য এ রাজ্য থেকে অন্তত ২৩টি আসন জেতা। গত শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের আলিপুর দুয়ারের একটি প্রচারণা থেকেও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসকে উপড়ে ফেলার ডাক দিয়ে অমিত শাহ বাংলা থেকে ২৩টি লোকসভার আসনে জেতার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন। তাই রাজ্যে বাড়তি চাপ বাড়াতে দফায় দফায় আসতে চলেছে মোদি-অমিত জুটি। অমিত শাহর পর আগামী ৩ এপ্রিল রাজ্যে দুটি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-তার একটি হবে ব্রিগেডে। দিদির জনপ্রিয়তায় তৃণমূলের দুর্গ পশ্চিমবঙ্গে ভাগ চান এবার মোদি। ৭ এপ্রিল ফের রাজ্যের কোচবিহারে একটি জনসভা করবেন তিনি। এ ছাড়াও দলের কেন্দ্রীয় ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা তো আছেনই। যদিও এ নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপির ২৩ আসনে জেতার সম্ভাবনা নিয়ে অমিত শাহকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের মহাসচিব ও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি বলেন ‘২৩টা কেন, একটা আসনও পাবে কিনা সন্দেহ আছে। বাংলা সম্পর্কে অমিত শাহর ধারণা খুবই কম। বিজেপি বলছে পদ্ম ফুটবে-কিন্তু সেটা পাঁকে ফুটবে না দিল্লিতে বাদ যাবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তাই একে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। বাংলার মানুষ মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেই আছে।’  বসে নেই ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলও। মোদি বিরোধী ঝড় তুলতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে তারাও। প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রে দুটি করে জনসভা করার লক্ষ্য নিয়েই চলতি সপ্তাহের শেষ দিক থেকেই প্রচারণায় নামছেন দলনেত্রী মমতা। শুরুটা করবেন উত্তরবঙ্গের দুটি আসন আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার দিয়ে। বিজেপি বিরোধী দলের অন্যতম মুখ মমতা দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছেন ‘৪২টার মধ্যে সবকটি আসনেই জিততে হবে।’ যদিও তৃণমূলের এই হুঙ্কারকে আবার উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন ‘রাজ্যের মানুষ এখন তৃণমূলের ওপর বীতশ্রদ্ধ। তারা এখন এই সরকারের বিদায় চাইছে। আসন্ন ভোটেই তার প্রমাণ মিলবে।’ অতএব লড়াই যে সমানে-সমানে হবে তা পরিষ্কার।

এবারের প্রচারণায় মমতার আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হলো মোদি সরকারের নোট বাতিল, অসহিষ্ণুতা এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোকে রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা অন্যদিকে মমতার মুসলিম তোষণ নীতি, রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া, বালাকোটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে ভারত বিরোধী মনোভাবকে হাতিয়ার করতে চায় বিজেপি। তবে এতকিছুর পরও বিজেপির কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘দিদি’র জনপ্রিয়তা।

সম্প্রতি একাধিক জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, এ রাজ্যে প্রধান লড়াই হতে চলেছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। নির্বাচনে তৃণমূলের দখলে যেতে পারে ৩১টির মতো আসন, বিজেপি পেতে পারে ৮-১০টি আসন।

এই পূর্বাভাস থেকেই পরিষ্কার ধারে ও ভারে অন্যদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে তৃণমূল। বিগত ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পায় তৃণমূল, মোট ৩৪টি আসনে জয় পায় তৃণমূল। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ভোট বেড়ে হয় ৪৫.৩ শতাংশ। জেতা আসনের সংখ্যা ২১১টি। দুই ধরনের নির্বাচনেই তাৎপর্যপূর্ণভাবে নিজেদের ভোট বাড়িয়ে রাজ্যটিতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয় তারা। 

তবে সন্দেহ নেই যে বাংলায় বিজেপিও ক্রমবর্ধমান শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট শতাংশের বিচারে কংগ্রেসের (১২.৪ %)-এর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছিল বিজেপি (১০.৩ %)। বিধানসভায় (মোট আসন ২৯৪) তিনটি আসনে জয় পায় বিজেপি। ২০১১ সালে যা ছিল মাত্র একটি। পরবর্তীতেও পঞ্চায়েত নির্বাচন, পুরসভা কিংবা উপনির্বাচনেও তাদের শক্তির প্রমাণ দিয়েছে তারা। আর বিজেপির এই বৃদ্ধিতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিপিআইএম তথা বামেরা।

বাংলায় নিজেদের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অস্তিত্ব প্রমাণ করতে আসন্ন নির্বাচনে ফের একবার শক্ত রাজনৈতিক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে চলেছে বামেরা। ১৯৭৭ সাল থেকে একটানা ৩৪ বছর রাজত্ব করা দলটি এখন অতীতের ছায়া নিয়েই বেঁচে আছে। ভোট ব্যাংকে ধস, নেতৃত্ব সংকট, নিজের দল ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান এবং বিজেপির উত্থান-এসব কিছুর বিরুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে লড়াই করতে হচ্ছে বামেদের। এমন অবস্থায় আসন সমঝোতা না হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেসের মতো বামেদেরও একা লড়াই করতে হচ্ছে।

সিপিআইএম পলিটব্যুরোর সদস্য হান্নান মোল্লা জানান, ‘আসন্ন  লোকসভার নির্বাচনে এ রাজ্যে প্রকৃতপক্ষেই আমাদের কাছে অন্যতম কঠিন রাজনৈতিক লড়াই হতে চলেছে। আমরা কখনই ভাবিনি যে রাজ্য রাজনীতিতে এরকম একটা অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে। আমরা আশাবাদী যে মানুষ যখন বুঝতে পারবে যে তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি নয়, বামেরাই হতে পারে তখন-এই অবস্থার পরিবর্তন হবে।’

সিপিআইএম ছাড়াও বামফ্রন্টে রয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি ও সিপিআই-এর মতো দলগুলো। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ঝড়ে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে মাত্র দুটি আসনে জয় পেয়েছিল বামফ্রন্টের প্রধান শরিক দল সিপিআইএম। কিন্তু এবার  জোট না হওয়ায় সেই দুটি আসনও ধরে রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে দলের মধ্যেই। সিপিআইএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী জানান, ‘আমরা যদি কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে পারতাম। তবে অনেক আসনেই ফলাফল অন্যরকম হতো। আমরাই তৃণমূলের বিকল্প বিশ্বাসযোগ্য ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে উঠে আসতাম।’

সর্বশেষ খবর