মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

গুলশান আগুনে শত কোটি টাকার ক্ষতি

মার্কেট দ্রুত সংস্কার করুন, নইলে রাস্তায় বসে যাব ব্যবসায়ীদের হুমকি । রাজউকের অভিযান শুরু

মাহবুব মমতাজী

মাথার ওপর আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু শেড। নিচে ধ্বংসস্তূপ। তখনো বাতাসে ছড়াচ্ছিল আগুনে পোড়া গন্ধ। এর মধ্যে কেউ কেউ পোড়া ছাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে পোড়া-আধপোড়া পণ্য। অথচ তিন দিন আগেও এখানে বাজার করতেন অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা। স্টিলের ছাদ আর লোহার ফ্রেমের মার্কেটটির বেশির ভাগ দোকানেই বিক্রি হতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, প্রসাধনী ও গৃহস্থালির সরঞ্জাম। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আনাগোনায় জমজমাট ছিল ছিমছাম মার্কেটটি। কারণ আমদানি করা মানসম্মত জিনিস পাওয়ার নির্ভরযোগ্য স্থান এটি। বলছি গুলশান-১ ডিএনসিসি কাঁচাবাজার মার্কেটের কথা। দ্বিতীয় দফার আগুন দিশেহারা করে দিয়েছে এখানকার ব্যবসায়ীদের। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে গড়ে তোলা দোকানগুলো পুড়তে দেখে তাদের বুকের ভিতর যে হাহাকার করে ওঠে, সেটা যেন বুক চাপড়েও থামানো যাচ্ছে না।

এদিকে ডিএনসিসি মার্কেটের বাইরে পোড়া পণ্য বিক্রিতে ভিড় জমে। পুড়ে যাওয়া দোকানের কর্মচারীরা দোকানের পোড়া পণ্যের ভিতর থেকে আধপোড়া বের করে বাইরে নিয়ে কম দামে বিক্রি করছিলেন। সেখান থেকে বাছাই করে কসমেটিক্স, ক্রোকারিজ, পাপোস ও গৃহস্থলির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে দেখা যায় গুলশান এলাকার পথচারীদের।  শনিবার ভোরের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মার্কেটের ভিতরে থাকা ২১১টি দোকান। মোট পুড়ে যাওয়া দোকানের সংখ্যা ২৫২টি। একইস্থানে দুই বছর আগের আগুনের ক্ষত শুকাতে না শুকাতে দ্বিতীয় দফা ছোবলের জর্জরিত এখানকার ব্যবসায়ীরা। তারা জানালেন, এবারের আগুনে তাদের শত কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বড় ধরনের এই দুর্যোগ কাটিয়ে ব্যবসা নিয়ে আবার কীভাবে ঘুরে দঁাঁড়াবেন এমন হতাশা দেখা গেছে তাদের মধ্যে।

কাঁচাবাজার মার্কেটে থাকা ছোট ছোট ৮টি দোকানের সমন্বয়ে ছিল জিয়া স্টোর। তরল জাতীয় খাদ্যপণ্য আমদানিতে এ দোকানের সুনাম বেশ। বিদেশি শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুরি ওলিভ ওয়েল, সয়াসস ও সিরাপসহ নানা খাবারের পসরা সাজানোর উপকরণ মিলত এই স্টোরে। রাজধানী ও দেশের অন্যান্য এলাকার পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে এসব সরবরাহ করা হতো। গতকাল সকালে সেই পোড়া দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মালিক জহিরুল ইসলাম। এক সময়ের সাজানো দোকান এখন তার কাছে স্বপ্ন। নেড়েচেড়ে দেখছেন দোকানের পুড়ে যাওয়া বোতল ও প্যাকেটগুলো। আগুনের লেলিহান শিখা যখন নিজের দোকানে তখন তিনি ঘুমের মধ্যে। মার্কেটের আগুনের খবর কাঁচাবাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রথম জানতেন পারেন তার দোকানের এক কর্মচারী। হতভম্ব সেই কর্মচারী ছুটে আসেন মার্কেটে। তখন আগুন নিভাতে ব্যস্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ওইদিন জহিরুল ইসলামের ঘুম ভাঙে নিজ দোকানে আগুনের খবর শুনে। ততক্ষণে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে জীবিকা নির্বাহের সম্বল। এ প্রতিবেদককে জহিরুল জানান, ২০১৭ সালের জানুয়ারির আগুনেও পুড়েছিল তার দোকান। বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা আর ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নতুনভাবে দোকান সাজিয়েছিলেন তিনি। তার দোকানে প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল ছিল। সবকিছু পুড়ে গিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব। আবার কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন তার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। এখন শুধু অপেক্ষা করছেন সিটি করপোরেশন ও সরকারি সহায়তার সিদ্ধান্তের জন্য। আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী ও নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগুনে আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে শত কোটি টাকারও বেশি। ভোরে আগুন কীভাবে লেগেছে তা নিরূপণ করা যায়নি। তবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে আউয়াল মিয়ার মুদি দোকানের গলি থেকে। সেখান থেকে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো মার্কেটে। ডিএনসিসি মার্কেটটির আয়তন প্রায় ১ লাখ ৮০০ বর্গফুট। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বিস্তৃত মার্কেটটির পাশাপাশি দুটি ভবন রয়েছে। পশ্চিম দিকের দোতলা ভবনটি ‘পাকা মার্কেট’ নামে পরিচিত। এর পাশেই কাঁচাবাজারের মার্কেটটি। দুই বছর আগের আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর এ মার্কেট বাঁশ দিয়ে ছাউনি বানানো হয়। এ কাঠামো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় আসছে বর্ষাকালকে মাথায় রেখে সব দোকানদারের কাছ থেকে টাকা তুলে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে স্টিল আর লোহার ফ্রেম তৈরি করা হয়। এ কাজ শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় দফার আগ্নিকা  হলো।  লোহা-সিলভারের পুড়ে যাওয়া বাসনপত্র একত্রে সাজিয়ে বসেছিলেন শিকদার ক্রোকারিজের মাহমুদ আলী। তিনি বলেন তার দোকানের অর্ধকোটি টাকার বেশি মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। লোহার ৬০ লাখ টাকার যেসব মালামাল গলে গিয়ে অবশিষ্ট ছিল তা ভাঙারি হিসেবে মাত্র ৭ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। তার দোকান থেকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ক্রোকারিজ পণ্য সরবরাহ হতো। তিনি বলেন, এ দোকানের কয়েক লাখ টাকার ঋণ আছে। কীভাবে শোধ করব বুঝতে পারছি না। এ আগুনে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। কাঁচামালের ব্যবসায়ী আল আমিন জানান, আগুনে তার দোকানের অন্তত ১১ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। তিনি বিভিন্ন নামিদামি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সবজি ও কাঁচা তরকারি বিক্রি করতেন।

বহুতল ভবনের ত্রুটি খুঁজতে মাঠে রাজউক : রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোর অনিয়ম ও ত্রুটি খুঁজে বের করতে গতকাল একযোগে মাঠে নেমেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২৪টি পরিদর্শন দল। ১৫ দিন এই অভিযান চলার কথা। অভিযানের প্রথম দিনেই শতাধিক ভবন পরিদর্শন করেছেন রাজউকের প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা। এ সময় অসংখ্য বহুতল ভবনে অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। পরিদর্শনকারীরা অনিয়ম চিহ্নিত করে মালিকপক্ষকে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুধরে নেওয়ার পরামর্শ দেন। ভবন মালিকরা চিহ্নিত ত্রুটি সমাধান না করলে পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে রাজউক। পরিদর্শনকারীরা ১০ তলার ওপরের বহুতল ভবনগুলোর নকশা, বেজমেন্ট, কার পার্কিং, জরুরি বহির্গমন সিঁড়িসহ নানা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। রাজউক কর্মকর্তারা জানান, প্রথম পর্যায়ের এই অভিযানে ভবনগুলোর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে এবং পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে। রাজউকের ৮টি জোনের অধীনে আশুলিয়া, ধামসোনা, উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, মিরপুর, গুলশান, বনানী, মহাখালী, পূর্বাচল, ধানমন্ডি, লালবাগ, মতিঝিল, ভুলতা, কেরানীগঞ্জ, জুরাইন, সূত্রাপুর, ওয়ারী, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ ও সোনারগাঁ এলাকায় চলবে এ অভিযান। গতকাল সকালে জোন-৪ এর অধীন বনানীর কাকলী মোড়ে কয়েকটি ভবন পরিদর্শন করে রাজউকের একটি দল। ভবনগুলো অনুমোদনহীন ও নকশাবহির্ভূত কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়। ভবনের বেজমেন্ট, কার পার্কিং, জরুরি বহির্গমন সিঁড়িসহ নানা বিষয় পরিদর্শন করেন কর্মকর্তারা। এরপর প্রাসাদ ট্রেড সেন্টারে একটি রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে উচ্ছেদের নির্দেশ দেন রাজউক কর্মকর্তারা। ওই জোনে অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া রাজউকের পরিচালক মামুন মিয়া বলেন, ভবনের খালি জায়গায় নকশাবহির্ভূতভাবে রেস্তোরাঁ তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া লিফট ও জরুরি বহির্গমনেও মানা হয়নি নিয়ম। তিনি বলেন, আমরা নকশা যাচাই-বাছাই করে অনেক ভবনে অনিয়ম পেয়েছি। বনানীর এবিসি টাওয়ারের নকশা দেখতে চাইলে তারা ১২ তলার নকশা দেখায়। কিন্তু ভবনটি ১৩ তলা। ওপরের একতলা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিলে তারা ১৩ তলা অনুমোদিত একটি সংশোধিত নকশা দেখান। তাদের দুটো নকশা রাজউকে দেখিয়ে যাচাই করে নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর প্রাইম ইউনিভার্সিটি রাজউক প্রতিনিধিদের নকশা দেখাতে পারেনি।

এদিকে সকালে দৈনিক বাংলা এলাকায় অভিযান চালাতে দেখা যায় রাজউকের আরেকটি দলকে। সেখানে আল আরাফা টাওয়ার, আইএফআইসি ব্যাংক টাওয়ার, হোটেল হাসান, সুরমা টাওয়ারসহ বিভিন্ন বহুতল ভবন পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করেন।

জোন-১ এর অধীন গাজীপুর-আশুলিয়া এলাকায় প্রথম দিনে একটি বহুতল ভবন পেয়েছে রাজউক। ওই জোনের অথরাইজড অফিসার সরদার মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা টঙ্গীর আওজপাড়ার শফিউদ্দিন সড়কে একটি ১২ তলা ভবন পেয়েছি। সেটি রাজউক অনুমোদিত নয়, পৌরসভার অনুমোদন নিয়ে করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই ভবনে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থায় বেশ ত্রুটি পাওয়া গেছে।

অভিযান প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আশা করি অভিযানে ভবনগুলোর আসল চিত্র বেরিয়ে আসবে। তিনি আরও বলেন, বহুতল ভবনের আইন অমান্যের জন্য রাজউকের দায় নেই তা বলব না, তবে যারা ১০ তলা, ২০ তলা ভবন করেন তারাও সমাজের বড় মাপের মানুষ। এসব মানুষ যদি নিয়ম মেনে কাজ করেন তাহলে দেশটা এগিয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর