বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিএনপিও সংসদে যাবে!

খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তে আলোচনা চলছে, এপ্রিলেই প্যারোলে ছাড়া পেতে পারেন

মাহমুদ আজহার

সুলতান মনসুরের পথ ধরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিজয়ী গণফোরামের আরেক নির্বাচিত সদস্য মোকাব্বির খান গতকাল সংসদে শপথ নিয়েছেন। রাজনৈতিক অন্দর মহলে জোর আলোচনা, বিএনপির নির্বাচিত বাকি ছয়জন সংসদ সদস্যও শপথ নিয়ে সংসদে যাবেন। তবে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি চলছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আগ্রহী বিএনপি সংসদে আসুক। অনেকবার তিনি আহ্বানও জানিয়েছেন।

সূত্রে জানা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তে সংসদে যেতে রাজনীতিতে পর্দার আড়ালে দুই পক্ষের মধ্যে চলছে জোর আলোচনা। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা গত কয়েকদিন ধরে নিয়মিতই কথা বলছেন। এ ব্যাপারে আলোচনার অগ্রগতির অংশ হিসেবেই বেগম জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিতেই বেগম জিয়ার ‘প্যারোলে মুক্তি’ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। কয়েকজনমন্ত্রীও এ ব্যাপারে অবগত। প্রভাবশালী দুটি দেশও বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, শারীরিক সুস্থতার বিবেচনায় বেগম জিয়াও প্যারোলে মুক্তিতে রাজি হয়েছেন। লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসের যে কোনো সময় প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া। এ দিকে আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আলোচনার অগ্রগতি না হলে বেগম জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বেগম জিয়ার জামিনে মুক্তি চাই। তবে তিনি এখন খুবই অসুস্থ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যদি তার চিকিৎসার স্বার্থে বিদেশে চিকিৎসার জন্য সুপারিশ করেন, তখনই প্যারোলে মুক্তির প্রশ্ন আসবে। এখন পর্যন্ত চিকিৎসকরা এ ধরনের কোনো কথা বলেননি।’ খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তে বিএনপি সংসদে যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে গণমাধ্যমে নানা কথা লিখছে। বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে সরকার বা আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে বিএনপির কথাবার্তার তথ্যও আমার কাছে নেই।’

জানা যায়, সংসদে যোগদানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিএনপিকে চাপ দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতা-কর্মীরাও চাচ্ছেন বিএনপি সংসদে যাক। তবে সংসদে যাওয়া নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এতে রাজি হননি। তারপর নানামুখী চাপ ও বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তারা এখন রাজি বলে জানা গেছে।

ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান জাহিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমিও চরম বিপদে রয়েছি। নেতা-কর্মীদের ৯৫ ভাগই চান, আমরা যেন সংসদে যাই। এ ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে কোনো ইতিবাচক দিক নির্দেশনা নেই। তবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের শপথ নেওয়ার সময় আছে। এর মধ্যে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতেও পারে। তবে দল না চাইলে আমরা সংসদে যাব না।’ সূত্র জানায়, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বড় অংশই সংসদে যাওয়ার ঘোর বিরোধী। তাঁদের মতে, নির্বাচন বর্জন ও প্রত্যাখ্যানের পর সংসদে যোগ দিলে বিএনপির ‘রাজনীতি’ বলতে কিছু থাকে না। এতে দলীয় সরকারের অধীনে ভোটবিহীন এ সরকারকে বৈধতা দেওয়া হবে। এ নিয়ে দলের ভিতরে ও বাইরে বিএনপিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। তবে আরেক সংসদে গিয়ে সরকারের নানা ‘দুঃশাসন’ ও ‘অন্যায়ের’ বিরুদ্ধে কথা বলার পক্ষে। তাদের যুক্তি হলো, সংসদের ভিতরে ঐক্যফ্রন্টের যে কয়জন সংসদ সদস্য রয়েছেন তারাও সমালোচনার ঝড় তুলতে পারবেন। সংসদের পাশাপাশি রাজপথেও সরকারের সমালোচনা করা যাবে। বিএনপি যখন সংসদে যাবে তখন গণমাধ্যমসহ সবার চোখ থাকবে বিএনপির দিকে। এতে আগামী দিনে রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে আরও গতি আনা যাবে।

বিএনপি সংসদে যাবে কি না জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির সংসদে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যেসব আলোচনা হচ্ছে, এগুলো গণমাধ্যমের উড়ো খবর। ভোটবিহীন এ সংসদে বিএনপি যাবে না।’ বেগম জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে এ ধরনের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে আমরা তার জামিনের জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাব। আশা করি, তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পাবেন।’ জানা যায়, বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে দুই পক্ষই শর্তারোপ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশ চলে যেতে হবে। সেখানে তিনি শারীরিক চিকিৎসা করাতে পারবেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো কথাবার্তা বলতে পারবেন না। বিএনপির জনপ্রতিনিধিদের সংসদে যেতে হবে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শারীরিক অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে বেগম জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিতে হবে। মুক্তি পেয়ে তিনি যেখানে খুশি সেখানে চিকিৎসা নিতে পারেন। তিনি সুস্থ হয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ও যুক্ত হতে পারেন। তবে আলোচনার এক পর্যায়ে বিএনপি বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তিতে রাজি হয়। বিএনপি সংসদে যেতেও রাজি হয়। এদিকে দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি ও চিকিৎসার ব্যাপারে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাপ রয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ওপর। নেতা-কর্মীদের চাপে সিনিয়র নেতারা বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা চেয়ারপারসনের উন্নত চিকিৎসার দাবি জানান। খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার ব্যাপারে তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন। এরপর চিকিৎসাসহ সার্বিক বিষয়ে চেয়ারপারসনের মতামত জানতে গত ১৫ মার্চ শুক্রবার জুুমার নামাজের পরপরই কারাগারে দেখা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তারা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন এবং রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করেন। এ আলোচনার বড় একটা অংশ তার চিকিৎসা ও মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে ছিল বলে সূত্র জানায়। এ দিকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও গণফোরাম থেকে নির্বাচিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরেক সংসদ সদস্য মো. মোকাব্বির খান শপথ নিয়েছেন। তারা আশা প্রকাশ করছেন, শিগগিরই বিএনপি থেকে নির্বাচিত বাকি ছয়জন জনপ্রতিনিধও সংসদে যোগদান করবেন। জানা যায়, বিএনপির নির্বাচিত ছয় সদস্যও ভিতরে ভিতরে সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু দলীয় কৌশল ও চাপে তারা সংসদে যেতে পারছেন না। বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংসদে যোগ দেব কি না এ ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবে। এলাকার জনগণ চায়, আমরা যেন সংসদে গিয়ে সরকারের দুঃশাসনের প্রতিবাদ করি। কিন্তু বাস্তবতাও দেখতে হবে। আমি দল করি-এ কারণেই জনগণ আমাকে চেনে। আমাদের কারাবন্দি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান না চাইলে সংসদে যাব না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর