বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনা

শাবান মাহমুদ

শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও সরকারের নেতৃত্বদানে শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। দলের নেতা-কর্মীরাই শুধু নন, আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী, নাগরিক সমাজ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শরিকরাও এমনটি মনে করেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রীর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে নতুন নেতৃত্বকে এগিয়ে আসবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসা তো দূর কথা শেখ হাসিনার বিকল্প কাউকে ভাবতেই রাজি হননি নেতা-কর্মীরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এবং দেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মানি সফরকালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আগামীতে তার দল বিজয়ী হলেও তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হবেন না। প্রায়ই তিনি বলে আসছেন যে, তার বয়স হয়েছে, তিনিও ক্লান্ত হন। অনেক হয়েছে, আর নয়। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনো শেখ হাসিনার বিকল্প নেতৃত্ব যেমন তৈরি হয়নি তেমনি দল ক্ষমতায় এলে দেশ চালনার দায়িত্ব নিতে তার মতো রাষ্ট্রনায়কোচিত, প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব দলে নেই। বিশ্বরাজনীতিতেও তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সে অভিজ্ঞ, সফল রাজনীতিকরা দল ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব হলেও শেখ হাসিনা এখনো শারীরিকভাবে যেমন সক্ষম তেমনি কর্মেও বয়সের তুলনায় যথেষ্ট সচল। সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে দল এবং দেশ পরিচালনায় প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা নিরন্তর কাজ করেন। তাহাজ্জুদের নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াত আর দৈনিক পত্রিকা পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দিনে তিনি ফাইলের পর ফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেন। তার কাছে কোনো ফাইল আটকে থাকে না। মন্ত্রিসভা বৈঠক থেকে শুরু করে একনেকের বৈঠকের সব এজেন্ডা ও প্রকল্প সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল থাকেন। দলের তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি নেতা-কর্মী সম্পর্কে যেমন পরিষ্কার ধারণা রাখেন, যোগাযোগ রাখেন, তেমনি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবীর কর্মকা  সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা রাখেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের হাতে পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজনসহ সবাইকে হারিয়ে দিল্লির নির্বাসিত দীর্ঘ বেদনাদায়ক সময় অতিক্রম করে ১৯৮১ সালের ইডেন কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। সামরিক শাসনকবলিত অন্ধকার সময়ে গণতন্ত্রের বাতিঘর হয়ে স্বজন হারানের বেদনা নিয়ে দেশে ফিরে বৈরী স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার মতো অসীম সাহসিকতার সঙ্গে গণতন্ত্রের সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। দীর্ঘ ৩৮ বছরে তিনি আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীর আবেগ-ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আশ্রয় ও ঐক্যের ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বার বার তার জীবনের ওপর হামলা এসেছে। কারাদহন এসেছে। তবু তিনি মাথা নত করেননি। কঠিন ও কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর পর তিনিই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে দেশেই নয়, উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন। এমনকি সব গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহৎ ঐক্য গড়ে তুলে ছাত্রসমাজের আন্দোলনের অভিভাবকত্ব নিয়ে সামরিক শাসনের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে গণতন্ত্রের নবযাত্রায় দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ শাসকদের জমানো পাপের জঞ্জাল সাফসুতরো করে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার করে তাদের ফাঁসিতে ঝোলান। জনমত গড়ে গণরায় নিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে গিয়ে বিশ্ব মোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতার অসমাপ্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি এখন নিরলস পরিশ্রম করছেন। কঠোর হাতে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ দমন করে মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর উচ্চতায় নিয়েছেন। দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে শুধু উৎসাহিতই করেননি, তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবও ঘটিয়ে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশের অগ্রগতিকে এক কথায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্রপট দেখে হামেশাই অনেকে বলছেন, মাহাথিরের হাত ধরে যে মালয়েশিয়ার উত্থান ঘটেছে, লিকুয়ানের হাত ধরে যে সিঙ্গাপুর পৃথিবীতে মাথা উঁচু করেছে শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারবন্দী হয়ে উন্নত-আধুনিক রাষ্ট্রের চেহারা নিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে দলের সারা দেশের এখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই শেখ হাসিনার সৃষ্ট কর্মী। শেখ হাসিনার আন্দোলন-সংগ্রামে দৃঢ়তার সঙ্গে বার বার রাজপথে নেমে তারা নেত্রীর প্রতি তাদের আনুগত্যের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই কর্মীরাই তাকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় গণতন্ত্রের মানসকন্যা থেকে দেশরত্ন উপাধিতে ভূষিত করেছেন। এই কর্মীরাই তার দেশে আসার পর স্লোগান তুলেছিলেন- ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই আমরা আছি লাখো ভাই’। এই কর্মীরাই আবার স্লোগান দিচ্ছেন- ‘শেখ হাসিনার হাতে যতক্ষণ দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ’। নেতা-কর্মীদের সব আবেগ-অনুভূতি আশ্রয়ের ঠিকানা শেখ হাসিনা; তাই তারা দল ও সরকারের নেতৃত্ব থেকে তাকে সরে দাঁড়াতে দিতে নারাজ। আগামী অক্টোবর কাউন্সিলেও তিনি সরতে চাইলেও তারা তা হতে দেবে না। নেতা-কর্মীরা মনে করেন যত দিন তিনি সক্ষম-সুস্থ থাকবেন তত দিনই নেতৃত্ব দেবেন। তার নেতৃত্বে দলের সাফল্যই কেবল অর্জিত হয়নি, রাষ্ট্রও উন্নয়নের সড়ক ধরে শিল্পবিপ্লবের দিকে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান এমপি এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে শেখ হাসিনা আমাদের বিকল্পহীন এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী। তিনি বাংলাদেশের গণমানুষের নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। গত ৩৮ বছরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে তিনি কেবল দেশের প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটির সভানেত্রীই নন, দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছে একজন অপরিহার্য নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তার সুদক্ষ নেতৃত্বের কারণে দেশের ১৬ কোটি মানুষ মনে করে শেখ হাসিনার কাছেই নিরাপদ বাংলাদেশ।’ সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষ যে স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখে সেই বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য একমাত্র শেখ হাসিনাকেই বার বার প্রয়োজন। দেশ এখন যে উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটে চলেছে তা গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে শেখ হাসিনার মতো দক্ষ, যোগ্য ও সাহসী নেতার মতোই একজন রাষ্ট্রনায়ক প্রয়োজন। আমরা মনে করি আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার জায়গা পূরণের মতো কোনো নেতা আমাদের দলে নেই। শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বেই দল এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এটিই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর প্রত্যাশা।’

আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগকে শুধু খি ত করাই নয়, নিঃশেষ করারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল সাময়িক দুর্বল করতে পারলেও জিয়াউর রহমান তার মনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। শত প্রতিকূলতার মাঝে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশের মাটিতে পা রাখেন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের হাল ধরেন। দলের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘ ত্যাগ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে শেখ হাসিনা পরিণত হন আস্থার ঠিকানায়। ঘুরে দাঁড়ায় দল। দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। যার পুরো কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। ক্ষমতার পাঁচ বছরে দেশবাসী পায় একজন সফল প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু পাঁচ বছর পরই আবার শুরু বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন। এ সময় আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল এবং কর্মী-সমর্থকদের ওপর যে সন্ত্রাস-নির্যাতন চলে তার ভিতর দিয়ে নতুন করে প্রমাণিত হয় শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। পরপর টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলাদেশেই নন, বিশ্বের অনেক রাজনীতিবিদের কাছে অনুকরণীয়। শেখ হাসিনা শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নন, তিনি এখন বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছেন। শেখ হাসিনা তিলে তিলে আওয়ামী লীগকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, দলকে সংগঠিত করেছেন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হয়ে থাকবে অনুসরণীয়। তিনি শুধু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছেই নন, বরং সর্বস্তরের মানুষের কাছে একজন সুদক্ষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও অগ্রগণ্য। কাজেই আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। কিন্তু নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। তার প্রতি নেতা-কর্মীদের যে পরিমাণ আস্থা রয়েছে অন্য কোনো নেতার প্রতি তা নেই। ফলে তিনি জানেন তার বিকল্প নেতৃত্ব কে হতে পারেন। তিনি তো আর আজীবন থাকবেন না। কিন্তু এ দেশ এবং দল পরিচালনার জন্য এখন থেকেই তার সুযোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে নিতে হবে নেতা-কর্মীদের।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ উপমহাদেশে আওয়ামী লীগ অনেক পুরনো সংগঠন। এ সংগঠনে নতুন নেতৃত্বের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ সংগঠন পরিচালনা করার জন্য যে সক্ষমতা, দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োজন তা বর্তমানে একমাত্র শেখ হাসিনারই রয়েছে। হতে পারে দীর্ঘদিন ধরে তিনি দলের দায়িত্বে রয়েছেন। তার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু দলের নেতারা শেখ হাসিনা ছাড়া বর্তমানে কাউকে মেনে নেবেন না। তৃণমূলের কর্মীরাও এমনটা কল্পনা করেন না। বর্তমানে শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ কল্পনা করে না।’ এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মধ্যে শেখ হাসিনার বিকল্প বর্তমানে নেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দেশকে, দেশের জনগণকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এতটা ভিশন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো তার বিকল্প সম্ভব নয়।’

সর্বশেষ খবর