বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা
মোদি-মমতার আঘাত-পাল্টা আঘাত

দিদি উন্নয়নের স্পিডব্রেকার আপনি এক্সপায়ারি বাবু

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

দিদি উন্নয়নের স্পিডব্রেকার আপনি এক্সপায়ারি বাবু

জবাব পাল্টা জবাব। প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। মোদি-মমতা এই দ্বৈরথেই জমে উঠল পশ্চিমবঙ্গের হেভিওয়েট নির্বাচনী প্রচারণা। গতকাল দুপুরে রাজ্যটির শিলিগুড়ি ও কলকাতার ব্রিগেড ময়দান-দুটি জনসভায় বক্তৃতাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক সুরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে তোপ দাগেন। আর বিকালে কোচবিহারের দিনহাটা জনসভায় তার প্রতিটির কড়া জবাব দিয়েছেন মমতাও। এমনকি মোদিকে তার সঙ্গে পাঙ্গা না নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখেন মমতা। এদিন দুপুরে শিলিগুড়ির সভায় মমতাকে ‘স্পিড ব্রেকার’-এর সঙ্গে তুলনা করে মোদি বলেন দিদির কারণেই পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। জনসভায় মোদি বলেন, ‘আপনারা এই বিজেপি ও চৌকিদারকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। আপনাদের সমর্থন পেয়ে আমি সবার সঙ্গে মোকাবিলা করছি। আপনাদের সঙ্গে থেকেই গত পাঁচ বছরে দেশজুড়ে উন্নয়নের রাস্তা দেখিয়েছি। কিন্তু যে গতিতে আমি  দেশের অন্য রাজ্যে উন্নয়নের কাজ করছি সেই গতিতে বাংলায় পারছি না। এর কারণ আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। পশ্চিমবঙ্গে একটা স্পিড ব্রেকার আছে-এই স্পিড ব্রেকারকে আপনারা ‘দিদি’ বলে চেনেন। এই দিদি আপনাদের উন্নয়ন স্তব্ধ করে দিচ্ছেন। গরিবদের জন্য এই দিদির কোনো চিন্তা নেই। উনি গরিবদের নিয়ে রাজনীতি করতেই বেশি ব্যস্ত কারণ

দারিদ্র্যতা শেষ হয়ে গেলে তার রাজনীতিও শেষ হয়ে যাবে। কংগ্রেস ও বামদেরও এই একই অবস্থা। গরিবি এদের খুব প্রয়োজন। গরিবদের গরিব করে রাখলে ওদের রাজনীতিতে ফায়দা আছে। এই কারণে তারা গরিবদের উন্নয়নে ব্রেক লাগিয়ে রেখেছে। আমি এখন এই স্পিড ব্রেকার সরার অপেক্ষায় রয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জবাবে মোদিকে ‘এক্সপায়ারি বাবু’ বলে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, ‘এবার থেকে আপনাকে আর প্রধানমন্ত্রী বলব না। কারণ সরকারের এক্সপায়ারি হয়ে গেছে। তাই আমি বলব এক্সপায়ারি বাবু। আপনি বলেছেন তৃণমূল নাকি গরিবদের জন্য কাজ করে না। কিন্তু আপনি গত পাঁচ বছরে কী করেছেন? উত্তর দিন। আপনি যদি মনে করেন যা বলেছেন সত্যি হবে আসুন আমার সঙ্গে বিতর্কে আসুন। আপনি প্রশ্ন করবেন আর আমি প্রমাণ দিয়ে তার উত্তর দেব। রোজ রোজ মিথ্যা কথা বলবেন না। ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতি নিয়ে ৫৬০ ইঞ্চি মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন। কুৎসা করছেন আর অপপ্রচার করছেন।’ সবার উদ্দেশ্যে মমতার প্রশ্ন ‘কন্যাশ্রীতে আমাদের মেয়েরা বৃত্তি পায় কি-না? খাদ্যসাথীতে ২ রুপি করে চাল দেওয়া হয় কি-না? সবুজসাথীতে সাইকেল দেওয়া হয় কি-না? বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয় কি-না? এমনকি মানুষ মারা গেলেও দাহ করার জন্য ২ হাজার রুপি দেওয়া হয়।’ অনুপ্রবেশ ইস্যুতে মোদি বলেন ‘যেভাবে সন্ত্রাসবাদ ও নকশাল দমনে এই চৌকিদার কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে ঠিক সেভাবেই এই মোদি অনুপ্রবেশকারীদেরও ছেড়ে দেবে না। অন্যদিকে যারা শরণার্থী আছেন তাদের সঙ্গেও ন্যায় বিচার করা হবে।’ জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে রাজ্যে যে ভয় ছড়ানোর প্রচেষ্টা করা হচ্ছে তা ঠিক নয়। এনআরসি চালু হলে গোর্খা জনজাতিদের কোনো ক্ষতি হবে না বলেও আশ্বাস দেন মোদি। তিনি আরও বলেন, ‘এ রাজ্যে যারা সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা করছে তাদের জানিয়ে দিতে চাই যে ওদের দিন শেষ। বিজেপি ক্ষমতায় এলে নির্দোষ ব্যক্তিদের ওপর হামলাকারীদের হিসাব দিতে হবে এবং আইনের মুখোমুখি হতে হবে। এই জগাই-মাধাই গু া ও অনুপ্রবেশকারীদের আঁতাতের দিন শেষ হতে চলেছে।’ এই ইস্যুতে দিনহাটার জনসভায় মমতা বলেন, ‘বিগত পঞ্চায়েত ভোটে জগাই-মাধাই-গদাই স্লোগান তো আমরাই তুলেছিলাম। তোমরা নিজে কিছু তৈরি কর। সিপিআইএমের লোকেরা সকালে বাম করে, দুপুরে কংগ্রেস আর রাতে বিজেপি করে বেড়ায়। এক্সপায়ারি প্রধানমন্ত্রী, একটা কথা মাথায় রাখবেন- আপনি হিটলারি কায়দায় গায়ের জোরে মিথ্যা বলছেন।’ শিলিগুড়ির জনসভায় পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভিযান নিয়েও তৃণমূল নেত্রীকে নিশানা করেন প্রধানমন্ত্রী। মোদি বলেন, এবারের নির্বাচন হবে দুটি পক্ষের মধ্যে- এক দিকে থাকবে সৎ চৌকিদার অন্যদিকে সব দুর্নীতিবাজ। একদিকে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কড়া জবাব দেওয়া সরকার অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া কয়েকজন ব্যক্তি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বালাকোটে বিমানবাহিনী ঢুকে জঙ্গিদের হত্যা করার পর আমাদের সবার মাথা গর্বে উঁচু হয়েছে। জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ইসলামাবাদ, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডিতে যে ব্যথা হয়েছে তার থেকেও বেশি যন্ত্রণা পেয়েছেন কলকাতায় বসে থাকা দিদি। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে বিমানবাহিনীর এই অভিযান যখন সবাই সমর্থন করেছেন, তখন দিদির এটা পছন্দ হয়নি। তার মহাভেজালের সাথীদেরও তা পছন্দ হয়নি। তারা এত জোরে কান্না করছিলেন যে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে তারা হিরো হয়ে গেছেন।’ এর পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে মমতা বলেন, নির্বাচন কমিশন বলেছে যে ‘সেনাবাহিনীর’ নাম নেওয়া যাবে না তাহলে প্রধানমন্ত্রী বলেন কী করে? জওয়ানদের রক্ত নিয়ে রাজনীতি করছেন, আপনাদের লজ্জা করে না? পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার আগাম সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও আপনি ব্যবস্থা না নিয়ে জওয়ানদের মৃত্যুর মুখে কেন ঠেলে দিলেন, মানুষ তার উত্তর চায়। আমরা আপনাদের কাছ থেকে জাতীয়তাবাদের সার্টিফিকেট নেব না।’ বিকালে ব্রিগেড ময়দানে দ্বিতীয় জনসভায় মোদি বলেন, ব্রিগেডে এত মানুষ তিনি কখনো দেখেননি। তিনি বলেন, আপনাদের ভালোবাসায় আমি অভিভূত। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ২৩ মের আভাস পেতে গেলে ব্রিগেডের মানুষের এই ঢেউ দেখতে হবে। আমি আশ্বাস দিচ্ছি আপনারা যে ভালোবাসা দিচ্ছেন তা উন্নয়ন ও ভালোবাসা দিয়ে মেটাব।’ মোদির ওই বক্তব্যের পাল্টা মমতা অভিযোগ করেন, ‘যারা রুপির হাঙ্গর, তারা এখন হ্যাঙ্গার দিয়ে বৈঠক করছে। ১৯ মে নির্বাচন শেষে ওই হ্যাঙ্গারের মধ্যেই ঢুকে যেতে হবে। নয়তো তোমাদের আর ভারতে শাসন করতে দেবে না। তাই যতই গায়ের জোর দেখাও, বাংলার সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে লাভ নেই। আগে দিল্লি সামলাও তারপর বাংলার দিকে তাকাবে।’ তৃণমূলের পাশাপাশি কংগ্রেসকেও তোপ দাগতে ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী। দুটি সভা থেকেই কংগ্রেসের ইশহেতার প্রকাশ নিয়ে মোদি বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীরে আমাদের সেনাবাহিনী যে বিশেষ অধিকার পেয়ে থাকে, কংগ্রেস তা উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে-যা সেনাবাহিনীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে। কংগ্রেসের দেশের সেনাবাহিনীর ওপরই বিশ্বাস নেই-তাই এই ধরনের মন্তব্য করে।’ শিলিগুড়ির জনসভা দিয়েই সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে তার প্রচারণা শুরু করেন নরেন্দ্র মোদি। এবারের নির্বাচন বিজেপির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যটি থেকে অন্তত ২৩টি আসনে জেতার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতা অমিত শাহ। তাই সেই লক্ষ্যপূরণে গেরুয়া শিবিরের প্রথম সারির নেতারা বাংলার মাটি কামড়ে পড়ে থেকে প্রচারণায় ঝড় তুলতে চাইছেন।

আগামী ১১ এপ্রিল গোটা দেশের সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গেও লোকসভা নির্বাচনের প্রথম পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। প্রথম পর্বে রাজ্যটির কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসনে নির্বাচন। স্বাভাবিকভাবেই মোদি-মমতার এই দ্বৈরথ নিয়ে গোটা দেশের নজর ছিল বাংলার দিকে। আর তা নিয়েই শিলিগুড়ির সভা থেকে মোদি বলেন, ‘আজ দিল্লি থেকে বহু ক্যামেরা কলকাতায় পৌঁছেছে কিন্তু তারা যদি একবার শিলিগুড়ির এই জনসভায় উপস্থিত থাকতেন তবে তারা বুঝে যেতেন যে ঢেউ কাকে বলে। এরপরই মোদি মোদি ধ্বনি দিতে থাকেন সভায় উপস্থিত প্রত্যেকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি যে বাংলা যা করে সারা ভারত তা অনুসরণ করে। এখনো তাই হয়ে আসছে। আমার মতো রাজনৈতিক নেতারা যদি আজ এখানে এসে এত জনসমাগম না দেখতাম তবে বুঝতে পারতাম না যে দিদির নৌকা ডুবতে বসেছে।’

 

সর্বশেষ খবর