বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঢাকা-দিল্লি সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ, দুর্ভোগ চরমে

নিজস্ব প্রতিবেদক

মিরপুরের তৈরি পোশাক খাতের ডিজাইনার সাইদুল আমীন ঢাকা থেকে দিল্লি যাবেন। সরাসরি টিকেটের জন্য ট্রাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এই রুটে এখন আর কোনো ফ্লাইট চলে না। একমাত্র ভারতীয় এয়ারলাইনস জেট এয়ারওয়েজ চলত, সেটাও মাসখানেক আগে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তাকে কলকাতা হয়ে দিল্লি যেতে হবে।

ঢাকা থেকে দিল্লি আকাশপথে যেখানে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্ব, সরাসরি ফøাইট বন্ধের খবরে এটা বেড়ে গিয়ে সাইদুলের মনে হলো, দিল্লি এখন অনেক দূর...!

সাইদুলের মতো এমন অনেক যাত্রী যারা ঢাকা থেকে সরাসরি দিল্লি যেতে চান, পেশাগত বা ব্যবসায়িক কাজে, কিংবা চিকিৎসা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে, তারা পড়েছেন দুর্ভোগে। এই দুর্ভোগের কথা জানিয়ে রাজধানী ঢাকার এক বিমা কর্মকর্তা প্রবীর পাল গতকাল ফোন করে জানান, তিনি তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে দিল্লিতে থাকা আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চান। তার মা বয়স্ক যাত্রী বিধায় তিনি সরাসরি ফ্লাইট চাইছিলেন। কিন্তু হঠাৎ জানতে পারেন সেই ফ্লাইট বন্ধ। তার প্রশ্ন, বেসরকারি ফ্লাইট নাহয় বন্ধ, কেন দুই দেশের রাজধানীতে সরাসরি সরকারি ফ্লাইট চলছে না?

সংশ্লিষ্টরা জানান, পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ ও ভারত এই দুই দেশের ক’টনৈতিক সম্পর্ক যখন ঐতিহাসিকভাবেই ‘সেরা সুসময়ের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন দুই দেশের দুই জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন (‘ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার’) বিমান বাংলাদেশ ও এয়ার ইন্ডিয়া কারও দুই রাজধানীর মধ্যে সরাসরি কোনো ফ্লাইট পরিষেবা নেই, এই তথ্যটা বেশ অবাক করার মতোই।

অথচ একসময় বিমান ও এয়ার ইন্ডিয়া দুই দেশের সরকারের এই দুই সংস্থাই ঢাকা-দিল্লির মধ্যে সরাসরি বিমান চালাত, যদিও বেশ কয়েক বছর আগে তা বন্ধ হয়ে গেছে। আর এ সুযোগে গত কয়েক বছর দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই রুটটিতে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে ভারতীয় বেসরকারি বিমান সংস্থা জেট এয়ার।

জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকা-দিল্লি রুটে ডাইরেক্ট ফ্লাইটে মনোপলি ছিল ভারতের জেট এয়ারওয়েজের। যেহেতু রুটটি তাদের একচেটিয়া, অফ সিজনেও জেট রিটার্ন ফ্লাইটে ভাড়া নিত ৩৫ থেকে ৪০ হাজার রুপি (বাংলাদেশি টাকায় ৪২ থেকে ৪৮ হাজার!)।

তিন-চার বছর ধরেই এ পরিস্থিতির পুরো ফায়দা লুটে নিয়েছে ভারতীয় কোম্পানিটি। ঢাকা-দিল্লির মধ্যে যাদের সময়ের তাড়া থাকত, কিংবা যারা অসুস্থ রোগীকে দেখানোর জন্য ভারতের রাজধানীতে আসতেন, তাদের কাছে ডাইরেক্ট সার্ভিস বলতে একমাত্র অপশন ছিল জেট এয়ারওয়েজ। ফলে জেট এয়ার বেশি ভাড়া রাখা সত্ত্বেও এই ফ্লাইটে যেতে বাধ্য হতেন যাত্রীরা। বিশেষ করে অসুস্থ রোগী বা সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীদের ঢাকা থেকে দিল্লি যেতে হলে জেট ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু গত মাস থেকে একমাত্র অবলম্বন সেই ‘হাতের যষ্টি’ জেটও বন্ধ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় জেট এয়ারের ঢাকা অফিসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি।

এয়ার টিকেট বুকিং কোম্পানি এস এস ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী দীপক মন্ডল বলেন, বিমান বাংলাদেশ ও এয়ার ইন্ডিয়া বন্ধ থাকায় গত কয়েক বছর ঢাকা-দিল্লি রুটে একমাত্র ফ্লাইট পরিচালনা করত জেট এয়ার। কিন্তু লোকসানের কারণে তাদের সংস্থাটি এখন ডুবতে বসেছে। ফলে এই রুটে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি।

এয়ার টিকেট বুকিং এজেন্সির এই ব্যবসায়ী বলেন, কোম্পানিটির ব্যাংক ঋণ প্রায় ৮ হাজার ৯২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ১২৬টি বিমান বিশ্বের বিভিন্ন রুটে পরিচালন করত তারা। লোকসানের কারণে এখন মাত্র ৫৪টি বিমান চালাতে পারছে কোম্পানিটি। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ রুট ছাড়া বাকি রুটগুলোতে তারা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া কোম্পানিটিকে সহায়তার চেষ্টা করছে। তবে মনে হয় না এটি আর দাঁড়াতে পারবে।

দীপক মন্ডল বলেন, ঢাকা-দিল্লি রুটে অদূর ভবিষ্যতে বেসরকারি কোনো কোম্পানির ফ্লাইট পরিচালনা সম্ভব নয়। কারণ এর টিকেটপ্রতি ট্যাক্স প্রায় ১১ হাজার টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ মিলিয়ে যে ভাড়া দাঁড়ায়, সেটি প্রতিযোগিতামূলক নয়। তিনি বলেন, দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হলে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তারা জানান, অতীতে বাংলাদেশ বিমানসহ একাধিক এয়ারলাইনস ঢাকা-দিল্লি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। এ সময় তাদের ব্যবসাও ভালো ছিল। এই রুটে বিমান তখন রমরমা ব্যবসা করত। একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। আবার ২০১৩ সালের ২৩ মে এ রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়। একটি ৭৩৭ বোয়িং উড়োজাহাজ দিয়ে সপ্তাহে দুটো ফ্লাইট অপারেট করা হতো। তখন ঢাকা-দিল্লি-ঢাকার ভাড়া ছিল ২২ হাজার ৪০০ টাকা। যাত্রীও মোটামুটি বেশ ভালোই হতো। হঠাৎ মাত্র এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের জুনে লোকসানের অজুহাতে বিমান ঢাকা-দিল্লি ফ্লাইট স্থগিত করে দেয়। এর পর থেকে বিমান এ রুট বন্ধ রেখেছে।

বাংলাদেশ বিমানের জেনারেল ম্যানেজার (পিআর) শাকিল মিরাজ বলেন, ‘ঢাকা-দিল্লিতে বিমানের ফ্লাইট চালু ছিল। কিন্তু লোকসানের কারণে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন আবার যাত্রী-চাহিদার কথা ভেবে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। আশা করছি এ বছর থেকেই ঢাকা-দিল্লি রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু হবে।’

দুই দেশের রাজধানীর মধ্যে ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে দেশীয় আরেক এয়ার কোম্পানি ইউএস বাংলার। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ঢাকা-দিল্লি রুটে ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন। তবে ফ্লাইট পরিচালনার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত ঢাকার যাত্রীদের কাছে সত্যি দিল্লি দূর অস্ত...!

সর্বশেষ খবর