শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

থামছেই না আগুন

এবার পুড়ল খিলগাঁও হকার্স মার্কেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

থামছেই না আগুন

গভীর রাতের আগুনে পুড়ে ছাই খিলগাঁও হকার্স মার্কেট -বাংলাদেশ প্রতিদিন

থামছেই না আগুন লাগার ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। মুহূর্তে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন অনেক সচ্ছল মানুষ। এসবের কোনটি দুর্ঘটনা আর কোনটি বিরোধপূর্ণ স্থাপনায় মানবসৃষ্ট প্রতিহিংসার আগুন, তা নিয়ে বেশ জোরেশোরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এসব প্রশ্ন সামনে রেখেই এবার পুড়ল রাজধানীর খিলগাঁও রেললাইনসংলগ্ন সিটি করপোরেশন হকার্স মার্কেটের শতাধিক দোকান। বুধবার রাত সোয়া ৩টার দিকে এ মার্কেটে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ১৫টি ইউনিটের মাধ্যমে সোয়া দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ দুজন দগ্ধ হয়েছেন। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির শোক-আতঙ্ক না কাটতেই ২৮ মার্চ বনানীর অগ্নিকাণ্ডে  ২৬ জনের জীবন গেল। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীতে আগুন লেগে চলেছে। খিলগাঁও হকার্স মার্কেটের আগুন লাগার খবর পেয়ে মার্কেটের সামনে জড়ো হতে থাকেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা। তাদের চোখেমুখে সর্বস্ব হারানোর বেদনা। পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোর দিকে বিমর্ষ চেহারায় তাকিয়ে ছিলেন নিঃস্ব দোকানিরা। তাদের আহাজারিতে খিলগাঁওয়ের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, হকার্স মাকেট, উত্তরা মার্কেট, পূবালী মার্কেট পাশাপাশি হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হকার্স মার্কেট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনে হকার্স মার্কেটের অর্ধশতাধিক দোকান পুড়েছে। এ ছাড়া উত্তরা মার্কেটের ৩০-৪০টি ও পূবালী মার্কেটের ৫-৭টি দোকান পুড়েছে। আগুনে প্রায় ৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আগুন তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। বৈশাখ ও ঈদ সামনে রেখে দোকানগুলোয় বেশি মাল মজুদ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিলীপ কুমার ঘোষ জানান, বুধবার রাত সোয়া ৩টার দিকে খিলগাঁও মার্কেটে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট সোয়া দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। মার্কেটে ছোট-বড় প্রায় ১৩০০ দোকান ছিল। এর মধ্যে আনুমানিক অর্ধশতাধিক পুড়ে গেছে। কাপড়ের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৬টায় খিলগাঁও আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীসহ দুজন হাসপাতালে আসেন। তারা হলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মী মো. আবু মুসা ও তুষার নামে একজন। তুষার প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লেও মুসা ভর্তি আছেন। আগুনে তুষারের দুই পায়ের গোড়ালি ও মুসার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মার্কেটে মুদিসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান ছিল। এর মধ্যে কাপড়, ক্রোকারিজ, কসমেটিক, প্লাস্টিকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকানই বেশি। আগুনে হার্ডওয়্যার ও কামারপট্টির দোকানগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে তাদের শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে। সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘বুধবার রাতে বাসায় গিয়ে খাবার খেয়ে ঘুমাইছি মাত্র। তখনই ফোন পাইয়া লাফাইয়া উঠি। দৌড়াইয়া আইসা দেখি আমার দোকানের সব পুড়ে ছাই। আমি এখন কী করব? আমার তো সব শেষ হয়ে গেল।’ বাজারে তার একটি কাপড়ের দোকান ছিল। ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ জানান, বাজারে তার দুটি দোকান রয়েছে। এর একটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ভিতরের কোনো মালই বের করতে পারেননি। অন্য দোকান থেকে কিছু মাল বের করে আনতে পেরেছেন। ব্যবসায়ী আবুল কালাম মোল্লা জানান, ঈদ সামনে রেখে নতুন শাড়ি তুলেছিলেন দোকানে। কিন্তু রাতের আগুন ছাই করে দিল তার স্বপ্ন ও পুঁজি। দোকানে ৫০ লাখ টাকার মাল ছিল। তার মতো একই অবস্থা অনেকেরই। মামুন ট্রেডার্সের কর্মচারী হৃদয় হাসনাত বলেন, ‘আগুন আগুন বলে মানুষের চিৎকার শুনে তাড়াহুড়া করে কাপড়ের গোডাউনের তালা খুলে বের হয়ে আসি। এ সময় দেখতে পাই হকার্স মার্কেটে আগুন জ্বলছে।’ প্রত্যক্ষদর্শী নিরাপত্তাকর্মী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘উত্তরা মাকের্টে বসা অবস্থায় হঠাৎ হকার্স মার্কেটে আগুন দেখতে পাই। আমি চিৎকার করতে থাকি এবং বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করি। দোকান মালিকদের ফোন করি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলেও পানি সংকট থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়।’

আগুন নিয়ে হেলাফেলা নয় : শুষ্ক মৌসুমে সাধারণত আগুন লাগে বেশি। তবে গত এক সপ্তাহে রাজধানীতে একের পর এক আগুনের ঘটনা অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। বলা হচ্ছে, এসব আগুনের কোনো কোনোটি পরিকল্পিত নাশকতার আলামত। ২৮ মার্চ বনানীর অগ্নিকান্ডে  ২৬ তাজা প্রাণের মর্মান্তিক মৃত্যুর দুই দিনের মাথায় ৩১ মার্চ ভোরে গুলশানের ডিএনসিসি কাঁচাবাজার ও সুপার মার্কেটে পুড়ে ছাই হলো দুই শতাধিক দোকান। সেটিও দ্বিতীয়বার পুড়ল দুই বছরের মাথায়। ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি এ রকমই এক ভোরবেলায় এ মার্কেটে আগুন লাগে। অনেকে একে পরিকল্পিত নাশকতা বলে অভিহিত করেছেন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অগ্নিকা  নিয়ে বিভিন্ন আলোচনার ফাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়ে যাচ্ছে। তা হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ। তাদের মতে, রাজধানীতে যত আগুন লাগে তার ৮০-৯০ ভাগই শর্টসার্কিট থেকে। শর্টসার্কিটের বিষয়টি সব আলোচনাতেই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। তারা বলেন, একটি ভবনে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হবে সংযোগ নেওয়ার আগে তার একটা আগাম হিসাব বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের সব বাণিজ্যিক ভবন, ফ্ল্যাট, বাসাবাড়ি, কারখানায় ঘোষিত বিদ্যুৎ লোডের ২৫ থেকে ৫০ গুণ বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়।

 যদি ১০টি এসি, ১০টি ফ্রিজের আগাম হিসাব দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে ভবন ব্যবহার শুরু হয় কয়েক বছরের মাথায় দেখা যায় ওই ভবনে ফ্রিজ বসেছে ১০০টি, এসি লেগেছে ৪০টি। কম্পিউটার, টিভিসহ অন্যান্য উপকরণ তো আছেই। ফলে, বিদ্যুতের লোড অনেক বেড়ে যায়। এ লোড পরিবহনের ক্ষেত্রে তারেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। ক্যাপাসিটির বেশি লোড ওয়্যারিংয়ে ব্যবহৃত তারগুলো কত দিন বহন করতে পারবে সে হিসাব রাখে না কেউ। একপর্যায়ে ওই তার যখন স্বাভাবিকভাবে লোড নিতে পারে না, তখন তারের গায়ে প্রচ  তাপের সৃষ্টি হয়। সেই তাপ থেকে তারের শরীর ঢেকে রাখা রাবার/প্লাস্টিকে আগুন জন্মায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বাড়িতে একবার যে সুইচ, সকেট, প্লাগ লাগানো হয় আমৃত্যু তা আর বদলানো হয় না। এসি, ফ্রিজ, টিভির লুজ কানেকশন, পুরনো সুইচ, প্লাগ থেকেও আগুনের সূত্রপাত হয়। তারা বলেন, বিদ্যুতের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে সার্কিটব্রেকার অত্যন্ত কার্যকর। সার্কিটব্রেকারের দামও সামান্য, অথচ খুব বিপদে না পড়লে সার্কিটব্রেকারও বদলানো হয় না। লোড ক্যাপাসিটি অনুযায়ী একটি বাড়ির প্রতিটি রুমের জন্য আলাদা সার্কিটব্রেকার ব্যবহার করা জরুরি। ওয়্যারিংয়ে ব্যবহৃত তারসহ সুইচ, সকেট, প্লাগ উচ্চমানের হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সামান্য টাকা বাঁচাতে গিয়ে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিনে কোটি টাকার সম্পদকেও চরম ঝুঁকিতে ফেলা হয়। উল্লেখ্য, আগুন নেভানোর প্রস্তুতি ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম সংগ্রহের পাশাপাশি আগুন যাতে না লাগে সেদিকে নজরটা বেশি দিতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর