শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

জনপ্রিয় লেখক শংকর

ইমদাদুল হক মিলন

জনপ্রিয় লেখক শংকর

শংকরের নাম শুনেছি ক্লাস নাইন টেনে পড়ার সময়। আমার খালা-মামারা শংকরের লেখা পড়তেন। সেই সব লেখা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতেন। কলেজে ওঠার পর শংকরের লেখা আমি প্রথম পড়লাম। বইটির নাম এখনো পরিষ্কার মনে আছে ‘পদ্মপাতায় জল’। ছোট একটি প্রেমের উপন্যাস। এই উপন্যাসটির কথা তেমন কেউ বলেন না। হয়তো শংকরের পাঠকরা এই বইটির নাম ভুলে গেছেন। তাঁরা বলেন, ‘কত অজানারে’, ‘চৌরঙ্গী’ প্রথমদিককার এইসব লেখার কথা। চৌরঙ্গী তো ব্যাপক জনপ্রিয় উপন্যাস। শখানেক সংস্করণ হয়েছে বা তারও বেশি হতে পারে।  সিনেমা হয়েছে। সিনেমাটিও জনপ্রিয় হয়েছিল। লন্ডনের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা থেকে চৌরঙ্গীর ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়ে পৃথিবীর বিশাল পাঠকের হাতে পৌঁছে গেছে। একটা সময়ে চৌরঙ্গী পড়েনি এমন শিক্ষিত বাঙালি খুঁজে পাওয়া যেত না। শংকরের জনপ্রিয়তা শরৎচন্দ্রের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছিল। তিনি একের পর এক লিখছিলেন। আশা-আকাক্সক্ষা, জনঅরণ্য, সীমাবদ্ধ, এরকম আরও অনেক উপন্যাস। তাঁর উপন্যাসগুলো বেশির ভাগই ছাপা হতো আনন্দবাজার গ্রুপের পত্রিকায়। দেশ, আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যায়। আমি তখন থেকে তাঁর লেখার খোঁজখবর রাখি। তার বেশ কয়েক বছর পর দেশ পত্রিকায় তিনি একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক উপন্যাস লিখলেন। উপন্যাসের নাম ‘ঘরের মধ্যে ঘর’। শংকরকে অনেক উচ্চতায় তুলে দিলেন সত্যজিৎ রায়। শংকরের দুটো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করলেন তিনি। জনঅরণ্য ও সীমাবদ্ধ। কলকাতার জীবন ঘিরে লেখা উপন্যাস। করপোরেট কালচারের ছোঁয়া পাওয়া গেল ‘সীমাবদ্ধ’ উপন্যাসটিতে। ওই জীবনটিকে শংকর খুব কাছ থেকে দেখেছেন। দীর্ঘ জীবন তিনি ডানলপ কোম্পানির উচ্চপদে কাজ করেছেন। তাঁর মার্কেটিং সেন্স অসাধারণ। নিজের বইয়ের প্রচার-প্রচারণা এবং বিক্রির ক্ষেত্রে তাঁর ওই সেন্সটি তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন সুন্দরভাবে। শংকর সেভাবে গল্প লেখেননি। লিখেছেন উপন্যাস। মনীষীদের জীবনভিত্তিক রচনা। স্মৃতিকথা এবং ছোটদের লেখা। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখা তাঁর বইগুলোও খুব জনপ্রিয়। নিজের বই জনপ্রিয় করবার জন্য একবার তিনি ‘এক ব্যাগ শংকর’ বের করলেন। অর্থাৎ সুন্দর একটা ব্যাগের মধ্যেই শংকরের কয়েকটি বই পাওয়া যাবে। দামও কম। আলাদা করে কিনতে গেলে যে টাকা লাগবে ওই ব্যাগসহ কিনতে গেলে তার চেয়ে অনেক সস্তা পড়বে। আইডিয়াটা খুব কাজে লাগল। ‘এক ব্যাগ শংকর’ খুবই জনপ্রিয় হলো, যদিও এসব নিয়ে কোনো কোনো লেখক, সমালোচক এবং পাঠক বিরূপ মন্তব্য করছিলেন। যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। সন্দীপন এমনিতেই ছিলেন ঠোঁটকাটা। যা বিশ্বাস করতেন অকপটে বলতেন। ‘এক ব্যাগ শংকর’ নিয়ে তিনি একবার সম্ভবত কৃত্তিবাস পত্রিকাতেই লিখেছিলেন, ‘আমি বাজার করতে গিয়ে দেখলাম এক ব্যাগ শংকর কিনে এক ভদ্রলোক বইগুলো ফেলে দিয়ে ব্যাগে করে তেলাপিয়া মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।’ শক্তি, সুনীল, সন্দীপন, তারাপদ, শরৎ কুমার মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠী শংকরকে লেখকই মনে করতেন না। কিন্তু শংকর যে বিপুল জনপ্রিয় লেখক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর অনেক বইই দেড়-দুই লাখ করে কপি বিক্রি হয়েছে। তিনি গুরু মানতেন বিমল মিত্রকে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ‘মনে পড়ে’ নামে তাঁর যে স্মৃতিকথা আছে সেই বইতে এসব তথ্য পাওয়া যাবে।

শংকরের সঙ্গে পরিচয় হলো ১৯৯৮ সালে। আমার কলকাতার প্রকাশক নির্মল বুক এজেন্সি ও সাহিত্যমের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার সাহা শংকরের প্রচুর বই ছেপেছেন। শংকরের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক তাঁর। কলকাতায় গেছি, প্রদীপ আমাকে শংকরের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ছোটখাটো গোলগাল অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের হাসিমাখা মুখের মানুষ শংকর। খুবই আন্তরিকতা নিয়ে আমার সঙ্গে মিশলেন। চা-মিষ্টি খাওয়ালেন, তাঁর ড্রয়িংরুমে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। ফিরে আসার সময় খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, ‘কলকাতায় এসেছ। তোমার কাছে টাকা-পয়সা আছে তো? সংকোচ করো না। দরকার হলে আমার কাছ থেকে নাও।’ আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। তখনো পর্যন্ত ধারণা ছিল কলকাতার মানুষজন একটু কৃপণ স্বভাবের এবং আমাদের মতো আন্তরিক নন। সেদিন এই ধারণাটা আমার ভেঙে গেল। তার পরও বেশ কয়েকবার শংকরের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কলকাতা বইমেলায় নির্মল সাহিত্যমের স্টলে আর ঢাকায়। ২০১৫/১৬-এর দিকে শংকর ঢাকায় এলেন। ইউপিএল তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশ করেছে। সে উপলক্ষে আসা। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তাঁর বিশেষ বন্ধু। বইগুলোর প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো ঢাকা ইউনিভার্সিটির একটা অডিটরিয়ামে। আমার বন্ধু বদিউদ্দিন নাজির ইউপিএলের সঙ্গে আছেন। তিনি বললেন, শংকরের অনুষ্ঠানটি আমাকে উপস্থাপন করতে হবে। করলাম। সেই অনুষ্ঠানে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন শংকর। চমৎকার কথা বলেন। তাঁর রসবোধে সবাই মুগ্ধ। চ্যানেল আই আমাকে বলল শংকরের দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিতে। এক ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠান করলাম। এখানেও শংকর কথা বলে মাতিয়ে দিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। মণি এবং মুখোপাধ্যায় বাদ দিয়ে শুধু শংকর নামে লিখে তিনি বহু বহু বছর ধরে বাঙালি পাঠককে মাতিয়ে রেখেছিলেন। শংকর এখনো লিখছেন, প্রায়ই ‘দেশ’ পত্রিকায় নানারকম বিষয় নিয়ে লেখেন। তাঁর ভাষা স্বচ্ছ এবং আকর্ষণীয়। বেশ তরতর করে পড়া যায়। আমি মনে করি একজন লেখকের এই গুণটুকুই বা কম কী! শংকর বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর অবদান অবশ্যই বাংলা ভাষাভাষী পাঠকরা মনে রাখবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর