শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

৩০ দিনের ২২ আগুনে ক্ষতি হাজার কোটি

আগুন জ্বলছেই রাজধানীতে

মাহবুব মমতাজী

ঢাকায় থামছেই না আগুন। ঢাকা ছাড়াও অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনার খবর আসছে বাইরের কোনো কোনো এলাকা থেকেও। একের পর এক আগুনে ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। অব্যাহত এমন ঘটনায় আতঙ্ক বেড়েছে সাধারণ মানুষের মনে। কয়েক বছরের অগ্নিকাে  ক্ষয়ক্ষতির হার বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়। গত ৫ বছরে সারা দেশের আগুনে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০৯৯ কোটি ৭২ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯২ টাকা।

সম্প্রতি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ঘটনার পর থেকে শুরু করে খিলগাঁও পর্যন্ত ৩০ দিনে অন্তত ২২টি স্থানের অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে। চুড়িহাট্টা ও বনানীর ভয়াবহ আগুনে মারা গেছে অন্তত ৯৩ জন। তবে চুড়িহাট্টা ও বনানী ছাড়াও গুলশান-১ ডিএনসিসি মার্কেট, খিলগাঁও বাজারসহ কয়েকটি স্থানের আগুনে অর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ওইসব আগুনে এখনো তদন্ত অব্যাহত রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না। যেসব ভবনে অগ্নিনির্বাপণ বা ঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা নেই, তাদের নির্দিষ্ট সময় দিলে তারা কম্পøায়ান্স করে সেই ব্যবস্থা করে নিতে পারবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে গতকাল সকালে বারিধারার সোহরাওয়ার্দী এভিনিউয়ের একটি ভবনের সিঁড়িতে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ড হয়। দুপুরে কারওয়ান বাজারে নয়তলাবিশিষ্ট কাব্বুকস হার্ডওয়্যার মার্কেটের তৃতীয় তলায় আগুন লাগে। তবে এসব ঘটনায় কোনো হতাহত হয়নি। জানা গেছে, পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনের পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে ভাসানটেক ১৪ নম্বর এলাকার ৩ নম্বর বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ওই দিন রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে আগুন লাগে। এতে বস্তিতে প্রায় ৪০০ ঘর পুড়ে যায়। গত ২ মার্চ পুরান ঢাকার চকবাজারে একটি ভাঙারির দোকানে বিস্ফোরণের আগুনে ৩ জন দগ্ধ হন। গত ৩ মার্চ দুপুরে কারওয়ান বাজারে একটি গোডাউনে আগুন লাগে। গত ৮ মার্চ বিকালে রামপুরায় মোল্লা টাওয়ারে আগুন লাগে। গত ৯ মার্চ বিকালে মৌচাক আনারকলি মার্কেটে আগুন লাগে। গত ১৯ মার্চ মিরপুর-১৩ নম্বর সেকশনের একটি বাসায় বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে লাগা আগুনে স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজন দগ্ধ হন। গত ২৩ মার্চ পুরান ঢাকার লালবাগের শহীদনগরে কাগজের কারখানা, রামপুরা টিভি ভবনের বিপরীতে এবং নিউমার্কেট বিশ্বাস বিল্ডার্স ভবনসহ অন্তত ৩টি অগ্নিকা  হয়। গত ২৬ মার্চ মগবাজারে জাজ মাল্টিমিডিয়ায় আগুন লাগে। ২৮ মার্চ বনানীতে ভয়াবহ অগ্নিকাে  ২৬ জনের মৃত্যু হয়। পরদিন ওই এলাকার অন্য একটি বাড়িতে আগুন লাগে। ৩০ মার্চ ভোরে গুলশান-১ নম্বরের ডিএনসিসি মার্কেটে এবং দুপুরে ডেল্টা ভবনে আগুন লাগে। একইদিন রাতে ধানমন্ডির ১১/এ সড়কের একটি বাসায় আগুন লাগে। ৩১ মার্চ ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে পর হাতিরঝিল সংলগ্ন পুলিশ প্লাজাতেও আগুন লাগার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বুধবার নিকুঞ্জ এলাকায় হঠাৎ এক প্রাইভেটকারে আগুন লাগে। গতকাল খিলগাঁও এবং বাড্ডা এলাকাসহ অন্তত দুটি স্থানে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। গত বছর সারা দেশের অগ্নিকাে  আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৫ টাকা বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস সূত্র। সংস্থাটির পরিসংখ্যানে ওই বছর অগ্নিকা-ের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৬৪২টি। উদ্ধারের পরিমাণ এক হাজার ১৮৪ কোটি ৫৭ লাখ ৬২ হাজার ৯১৯ টাকার মালামাল। আবাসিক বাড়ি-ঘরে আগুনের ঘটনা ছিল ৮ হাজার ৪৬১টি এবং শিল্প কারখানায় এ সংখ্যা এক হাজার ১৩১টি। এ ছাড়া ১৭৩টি গার্মেন্টে আগুনের ঘটনা ঘটে। বস্তিতে অগ্নিকা  হয় ১৬৫টি। এসব অগ্নিকা  মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে শিল্প কারখানা পরিদর্শন করা হয় ৪ হাজার ১৫৭টি। বিভিন্ন কলকারখানা ও মিলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৪ হাজার ৩২৮টিতে এবং প্রশিক্ষণার্থী ছিল এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৮৬ জন। সরকারি মহড়া অনুষ্ঠিত হয় ৩ হাজার ২৫৮টি এবং বেসরকারি মহড়ার সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ১৮২টি। সরকারি সার্ভে এক হাজার ২১৮টি এবং বেসরকারি ৩ হাজার ৭৫৮টি। এক হাজার ৫৬০টি বহুতল ভবনে পরিদর্শন করা হয়। আর গণসংযোগ করা হয়েছিল ১৪ হাজার ২৮৭টি। জানা গেছে, বেশিরভাগ আগুনের সূত্রপাত বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, চুলার আগুন, গ্যাস সিলিন্ডার, ছুড়ে দেওয়া জ্বলন্ত সিগারেট ইত্যাদি থেকে। প্রতিবছর গড়ে ১৯ হাজার আগুনের ঘটনা ঘটে। গত ১০ বছরে সারা দেশে ১ লাখ ৫০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকা  হয়। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজারের বেশি মানুষ। আহত হয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার। ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আগের বছরগুলোর তুলনায় ২০১৮ সালে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশি। বছর বছর এ হার বাড়তেও দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নিকা  হয়। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৫৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৬ টাকা। ২০১৬ সালে আগুনের ঘটনা ছিল ১৬ হাজার ৮৫৮টি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৪০ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ৮২২ টাকা। ২০১৪-২০১৮ পর্যন্ত ৮৯ হাজার ৯২৩টি অগ্নিকা  হয়। এতে ২০৯৯ কোটি ৭২ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯২ টাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপপরিচালক দেবাশিষ বর্ধন এ প্রতিবেদককে জানান, সব ঘটনার মধ্যে শুধু চুড়িহাট্টার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি দুই লাখ ৩২ হাজার টাকার। উদ্ধার হয়েছিল ৬৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার মালামাল। তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি অগ্নিকাে  হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নথিপত্র নষ্ট হওয়ায় এ ক্ষতি বেশিও হতে পারে।

সর্বশেষ খবর