মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নুসরাত লাইফ সাপোর্টে জানাল দুর্বৃত্তদের কথা

সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ, মামলা আটক ৭

সাখাওয়াত কাওসার

নুসরাত লাইফ সাপোর্টে জানাল দুর্বৃত্তদের কথা

নুসরাতের বাকরুদ্ধ মা, হৃদয়বিদারক কান্না ভাইয়ের -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ফেনীর সোনাগাজীতে অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে (১৮) সিঙ্গাপুর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বেলা ১২টার দিকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া নুসরাতের সর্বশেষ স্বাস্থ্য অবস্থার কাগজপত্র সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) বার্ন ইউনিট কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা নুসরাত গতকাল সকালে এবং ঢাকায় নিয়ে আসার সময় তার পরিবারের সদস্যদের কাছে ওই দিনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের কাছে দেওয়া দুই মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ওই অডিও ক্লিপটি এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এ ছাড়া অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় গতকাল আরও একটি মামলা করেছেন তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। ওই মামলায় সাতজনকে আটক করা হয়েছে।

গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় নুসরাতকে দেখার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী সচিব ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন নুসরাতের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিতে। তাই আমি এখানে তাকে দেখতে এসেছি। নুসরাতকে প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুর পাঠানো নির্দেশ দিয়েছেন। সব খরচ বহন করবে সরকার। যারা এই অপরাধ করেছে, তাদের বিচার তো হবেই, সঙ্গে আমরা নুসরাতের স্বাস্থ্যের বিষয়টির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি। তাকে যে কোনো মূল্যে সুস্থ করার চেষ্টা আমরা করছি।’

বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটু আগে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, নুসরাতকে যাতে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। তিনি নুসরাতের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, নুসরাতকে যদি সিঙ্গাপুরে পাঠানোর মতো পরিস্থিতি হয়, তাহলে তাকে যেন দ্রুত সেখানে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী আমি সিঙ্গাপুরে নুসরাতের সব কাগজপত্র আজই পাঠিয়ে দেব।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণত এত বেশি বার্ন সিঙ্গপুরের ওই হাসপাতাল গ্রহণ করে না। এর পরও যেহেতু প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তারা যদি রেসপন্স করেন, তাহলে আমরা নুসরাতকে দ্রুত পাঠিয়ে দেব।’

যা বলেছেন নুসরাত : ঢামেক বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ (মৃত্যুশয্যায় দেওয়া বক্তব্য) দিয়েছেন নুসরাত। গতকাল বেলা ১২টার দিকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার আগে দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ওই ছাত্রী একজন চিকিৎসকের কাছে বক্তব্য দেন বলে নিশ্চিত করেছে ঢামেক বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্র। নুসরাত তার বক্ত?ব্যে বলেছে, ‘নেকাব, বোরকা ও হাতমোজা পরিহিত চারজন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। ওই চারজ?নের একজনের নাম ছিল শম্পা।’ এর আগেও তিনি ৬ এপ্রিল ঘটনার পর অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আসার সময় তার পরিবারের সদস্যদের কাছে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। দুই মিনিট ৩০ সেকেন্ডের ওই অডিও ক্লিপসটি এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

অডিও ক্লিপসে শোনা যায়, অসহ্য যন্ত্রণায় কাতারাচ্ছিলেন নুসরাত। কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘আঁই (আমি) অন্যায়ের প্রতিবাদ করমু। আঁই সারা বাংলাদেশের কাছে কমু। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কমু। সারা দুনিয়ার কাছে কমু। অন্যায়ের প্রতিবাদ করনে এইডা হইলো আমার উপর। এইডা হইলো আমার উপর...।’

অডিও ক্লিপস এবং নুসরাতকে উদ্ধৃত করে ঢামেক সূত্র বলছে, কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নারীশিক্ষার্থীদের হয়রানি করে আসছেন। তিনি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখাতেন। তার কথায় রাজি না হলে ছাত্রীদের তিনি হেনস্তা করতেন। আগে এ বিষয়ে পরিবারকে না জানালেও ২৭ মার্চ তার সঙ্গে অধ্যক্ষ অশোভন আচরণ করেছেন বলে জানায় নুসরাত। বিষয়টি নুসরাত পরিবারকে জানানোর পাশাপাশি মাদ্রাসার অন্য শিক্ষার্থীদেরও জানায়। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর থেকে সে তার ভাইয়ের সঙ্গে মাদ্রাসায় যাচ্ছিল। ঘটনার দিন তার ভাইকে মাদ্রাসার ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুমূর্ষু রোগীদের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য নেওয়া হয়ে থাকে, যাকে ডাইং ডিক্লারেশন বা মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলা হয়, যা পরবর্তী সময়ে আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

নুসরাত ডাইং ডিক্লারেশনে বলেছে, কেন্দ্রে ঢোকার পর বোরকা পরিহিত এক মেয়ে তাকে বলে, তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে কয়েকজন বেধড়ক পেটাচ্ছে। এ খবর শুনে তিনি ছাদে উঠে নিশাতকে না দেখলেও নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পরিহিত চারজনকে দেখতে পায়। তাদের মধ্যে মূলত কথা বলছিল একজন। সে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বলে এবং অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য এ কথা বলতে নুসরাতকে চাপ দেয়। নুসরাত এতে অস্বীকৃতি জানালে ওই চারজন ওড়না দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলে। তার গায়ে তারা কিছু একটা ছুড়ে মারে। তারপর বলে, ‘যা এবার পালা।’ গায়ে আগুন লাগা অবস্থাতেই নুসরাত দৌড়ে পালাতে থাকে। ওই চারজনের কেউ কারও নাম উচ্চারণ না করলেও কোনো একপর্যায়ে একজন শম্পা বলে অন্য একজনকে ডাকে। তবে মুখ ঢাকা থাকায় কাউকে চিনতে পারেনি বলে জানিয়েছে নুসরাত। তবে যারা ওই সময় কথা বলেছে তাদের ছিল নারীকণ্ঠ।

এর বাইরে গতকাল সকাল ১০টার দিকে নুসরাতের সঙ্গে কথা বলেছেন তার ভাই নোমান। নোমান তার বোন নুসরাতকে উদ্ধৃত করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই, আমি মনে হয় বাঁচব না। মরে যাব। তোরা মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস। দায়ীদের যেন বিচার হয় সেদিকেও খেয়াল রাখিস।’ গতকাল বেলা ২টার দিকে ঢামেকের বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন নোমান।

মামলা, আটক ৭ : এদিকে ঘটনার তিন দিন পর নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। ফেনীর পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার জানান, ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত সাতজনকে আটক করা হয়েছে। সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। তারা অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, শনিবার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা শিরিন বেগম। মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিনই আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই মাদ্রাসাছাত্রীকে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

 

সর্বশেষ খবর