শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাঁচানো গেল না নুসরাতকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাঁচানো গেল না নুসরাতকে

নুসরাত। হাসপাতালে গতরাতে চিকিৎসককে জড়িয়ে স্বজনদের কান্না-আহাজারি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদের কারণে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মারা গেছেন। গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পাঁচ দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন নুসরাত। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার নির্দেশ দিলেও শারীরিক অবস্থার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে নুসরাতকে মৃত ঘোষণা করেন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন। আজ সকালে ময়নাতদন্ত হওয়ার পর ফেনীতে নেওয়া হবে তার লাশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। ফেনীর সোনাগাজীর মেয়ে নুসরাত এ বছর আলিম পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিলেন। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলেন তিনি। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ‘শ্লীলতাহানির’ অভিযোগ এনে গত মার্চে সোনাগাজী থানায় একটি মামলা করে নুসরাতের পরিবার। সেই মামলা তুলে না নেওয়ায় অধ্যক্ষের অনুসারীরা গত শনিবার পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ফেনী সদর হাসপাতালে এবং পরে শনিবার রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাতের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় গত সোমবার তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সোমবারই তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা নুসরাতের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। বিভিন্ন মেডিকেল রিপোর্ট পাঠানোর পর ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয় তাদের। এ অবস্থায় নুসরাতকে না পাঠানোর পক্ষে মত দেন সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা। গতকাল দুপুরেও নুসরাতের শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে সামন্ত লাল সেন বলেছিলেন, ‘সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের। রোগীর যে শারীরিক অবস্থা তাতে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার জন্য ৫ ঘণ্টা এয়ার জার্নি করার মতো অবস্থা তার নাই।’ নুসরাত ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, গত শনিবার সকালে তিনি ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রে আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বোরকা পরা চার নারী তাকে মামলা তুলে নিতে বলে। তাতে রাজি না হওয়ায় ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। জবানবন্দিতে নুসরাত বলেন, বোরকায় মুখ ঢাকা থাকায় ওই চারজনের কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। তবে একপর্যায়ে তাদের একজন আরেকজনকে শম্পা নামে ডেকেছে, সেটা তার মনে আছে। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিষয়ে সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন বলেন, জবানবন্দিতে নাম আসা শম্পাকে খুঁজতে গিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নুসরাতের সহপাঠী পপিকে আটক করা হয়েছে। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা আছে কিনা এবং এ ঘটনায় জড়িতদের সন্ধান পেতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা এখন পুলিশ রিমান্ডে আছেন।

অধ্যক্ষসহ তিন জন রিমান্ডে, ওসি প্রত্যাহার, মামলা পিবিআইতে : সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। ঘটনার পর থেকে বাদী পক্ষকে অসহযোগিতার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই ওসিকে প্রত্যাহার করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ সদর দফতর সূত্র। অন্যদিকে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাত দিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল জেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালত সিরাজউদ্দৌলাকে সাত দিন, শিক্ষক আফছার ও সহপাঠী আরিফকে পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন রাফিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলার মতো অবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা জানান, সোনাগাজী থানার ওসিকে প্রতাহার করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পিবিআই-কে।

অধ্যক্ষ জামায়াত নেতা : ছাত্রীর শ্লীলতাহানিকারী অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রোকন। বিভিন্ন অভিযোগে ২০১৬ সালে তাকে জামায়াত থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর ফেনী জেলা আমির এ কে এম শামসুদ্দিন। এ ছাড়া চেক জালিয়াতি, প্রতারণা ও নাশকতার অভিযোগে চারটি মামলা হলেও স¦পদে বহাল ছিলেন জামায়াতের এই সাবেক নেতা। এই ঘটনার ছয় মাস আগেও মাদ্রাসার এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন মাদ্রাসার আরেক ছাত্রী। ২০১৭ সালে চেক জালিয়াতির মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন।

ঢাবিতে মানববন্ধন : রাফির সঙ্গে যৌন হয়রানি এবং আগুনে পুড়িয়ে ‘হত্যাচেষ্টা’র প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন রাস্তায় এই মানববন্ধন করে তারা। পরে এতে যোগ দেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর এবং সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল সংসদের নেতারা।

 মানববন্ধন থেকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বক্তব্য দেন রাফির ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

সর্বশেষ খবর