শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে আজ দ্রোহের আগুনে প্রতিবাদের গণজোয়ার চাই

পীর হাবিবুর রহমান

ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে আজ দ্রোহের আগুনে প্রতিবাদের গণজোয়ার চাই

নুসরাত জাহান রাফি হতে পারত আমার মেয়ে। নুসরাত তো আমাদেরই মেয়ে। বাবারা জানেন মেয়ে তার কতটা আদরের। মায়েরা জানেন কতটা রক্তমাংস শেষ করে মেয়ের জন্ম দেন। কত বড় স্বপ্ন দেখতে দেখতে বেণি বেঁধে দিয়ে বড় করেন। ভাই জানে বোন তার কতটা মমতার, স্নেহের। নুসরাতও স্বপ্ন দেখেছে প্রজাপতির মতোন উড়তে উড়তে রাজকন্যার মতোন। একদিন আলোকিত মানুষ হতে নুসরাত বাবা-মায়ের নিরাপদ জানা মাদ্রাসায় পড়ালেখাকালেও মনের মতো সাজগোজ করে গেছে পরীক্ষা দিতে। চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে চলার বয়স ছিল তার। কিন্তু মাদ্রাসার অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে নুসরাত বড় অকালে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে চলে গেছে। শরীরের ৮০ ভাগ আগুনে পোড়া অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে তাকে চলেই যেতে হলো। প্রধানমন্ত্রী তাকে সিঙ্গাপুর পাঠাতে চেয়েছিলেন। গোটা দেশের মানুষ বিষাদগ্রস্ত হয়েছে। সবখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা-ক্ষোভ-নিন্দার ঝড় উঠেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনেটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক সামন্তলাল শেষ চেষ্টা করলেও বলেছিলেন, ১৫ ভাগ পুড়লেই সংকটাপন্ন। সেখানে ৮৫ ভাগ পুড়ে যাওয়া নুসরাতকে বাঁচানো কঠিন।

নুসরাতের অপরাধ কী ছিল? সে অধ্যক্ষের যৌন লালসার প্রলোভনে পড়েনি। ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার যৌন নিপীড়ন অনেকে দিনের পর দিন মুখ বুজে সয়ে গেলেও আমাদের মেয়ে নুসরাত রুখে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবাদে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিল। যৌন বিকৃত ধর্ষণকারী অধ্যক্ষের কীর্তি পরিবারকে জানিয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছিল। অধ্যক্ষ গ্রেফতার হলেও আইন নুসরাতকে রক্ষা করতে পারেনি। পারেনি তার পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে মামলা প্রত্যাহার করতে চাপ দেওয়া হয়। নুসরাত মাথা নত করেনি। তাকে সেই জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগের মতো গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অধ্যক্ষের অন্ধভক্ত বা সুবিধাভোগী বর্বর ছাত্রছাত্রীরাই তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছে। সে আর্তনাদ করতে করতে নেমে আসে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে শরীর ও মনের সকল যন্ত্রণা সয়েও বলেছিল, ‘আমি এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত করব। সারা বাংলাদেশের কাছে বলব। সারা দুনিয়ার কাছে বলব। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।’ এমন প্রতিবাদ শত বছরেও এভাবে জোরালো কখনো হয়নি। নুসরাত যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারীর প্রতি যৌন বিকারগ্রস্ত কামুক পুরুষের বর্বরতার বিরুদ্ধে সেটি করে, আজ এক অগ্নিদগ্ধ নরকযন্ত্রণায় সমাজকে ঝাঁকুনি দেওয়া প্রবল প্রতিবাদ। তুমুল প্রতিবাদের ইতিহাস। সমাজ কতটা নষ্ট হলে এমন ব্যভিচারের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ না গড়ে সিরাজের জন্য মানববন্ধন হয়! অথচ দেশে নারীবাদীরা রাস্তায় নামেননি। সমাজের বিবেকবান বা রাজনৈতিক শক্তি রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করেনি। দেশের শিক্ষার্থীরাও পথঘাট প্রতিবাদে উত্তাল করেনি। এতে অবাক হয়েছি। অন্তহীন দহনে রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় ফুঁসছি। তবু কোথাও কোনো প্রতিবাদের ঝড় উঠতে দেখিনি। সকল মানবিকতা যেন ধর্ষক আর যৌন নিপীড়কের কাছে নত হয়ে আছে।

কবি সুফিয়া কামালের হাত ধরে অসংখ্য নারী নেতৃত্ব মহিলা পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে মেয়েরা সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগই পাননি, মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। বিচারক হয়েছেন। সিনিয়র সচিব হয়েছেন। সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীরা দাপটের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে নারী আজ বিমানই চালাচ্ছেন না; গার্মেন্ট শিল্পকে বাঁচিয়েই রাখেননি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে উপ-উপাচার্য হয়েছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন পেশায়। তবু নারীর প্রতি নির্মমতা, সহিংসতা, ধর্ষণ, নিপীড়ন থামে না। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পুরুষদের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে অনেকাংশে নারীরা সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক জেলায় ডিসি, এসপির দায়িত্ব পালন করে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। রাজনীতি, আইন, বিচার, শাসন বিভাগসহ শিক্ষাদীক্ষায় নানা শ্রেণি-পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বিপ্লবের সূচনা করেছে। জাতীয় রাজনীতিই নয়, স্থানীয় রাজনীতিতেও নারীরা লড়াই করে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করছেন।

এমনি পরিস্থিতিতে তরুণীরা টি-শার্টে স্লোগান লিখেছে, গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না। এ ছবি ও খবর গণমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একদল বিকৃত পুরুষের যৌন বিকারগ্রস্ততার বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদের ভাষা। এটি এক জীবন্ত পোস্টার। নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন সমাজের সকল শ্রেণি-পেশায় উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, সকল পর্যায়ে ঘটেছে। কবি আবুল হাসানের ভাষায়, ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি নীরবে মুক্তা ফলাও।’ নারী নিপীড়নের অপমান যন্ত্রণা মুখ বুজে সয়েছে এতকাল। নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন আশির দশকের শেষ দিকে বিশেষ করে নব্বইয়ের শুরুতে গণতন্ত্রের নবযাত্রায় তারুণ্যের উন্মাদনার সময় সেটি সামনে নিয়ে আসেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একদল নিপীড়ক পুরুষ নারীকে যে কেবল ভোগের বস্তু দেখেন। অবলা নারীর বেশে দুর্বলের জায়গায় দাবিয়ে রাখতে চান। তার বিরুদ্ধে তির্যক বাক্যবাণে নিজের জীবনের ঘটনাসহ পরিবার সমাজের চিত্র সাহসিকতার সঙ্গে তুলে এনেছেন। সেই সাহসের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছেন সাম্প্রতিককালের নারীর হৃদয়ে। নারী তাই আজ প্রতিবাদ করতে শিখেছে। দেশের মাটিতে ফিরে পা না রাখার যন্ত্রণায় বেদনায় নিঃসঙ্গতায় কখনোসখনো বিষাদগ্রস্ত হলেও, ক্ষুব্ধ হলেও তার লেখার শক্তি সমাজে নারীকে তরুণীকে এই যে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে এটা অনেক বড় অর্জন। এ অর্জন কেবল একজন লেখক নিজের জন্য ঘটান না। সমাজের সভ্যতার বিবর্তনে অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। তরুণীদের এ প্রতিবাদের ভাষা যখন দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে, নারী ও মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলেছে, ঠিক তখন সুবর্ণ গ্রামের ধর্ষিতা জননী চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। শরীরের ক্ষত শুকালেও মনের যন্ত্রণা তার আজন্ম থেকে যাবে।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ-উদ-দৌলা ২৭ মার্চ নুসরাতকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেছিলেন। এ ঘটনায় তার মায়ের করা মামলায় অধ্যক্ষ এখন কারাগারে। এ অধ্যক্ষ দীর্ঘদিন থেকে ছাত্রীদের পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যৌন হয়রানি করে আসছিলেন। নুসরাত তার প্রলোভনে সাড়া দেয়নি বলে সে গায়ের জোর খাটিয়েছে।

ধর্মের পবিত্র উপাসনালয় মনে করে সন্তানদের পাঠানো মাদ্রাসায় ছাত্রীরাই নয়, ছাত্ররা পর্যন্তও যুগের পর যুগ বিকৃত যৌন ও নির্মম শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। কেবল মাদ্রাসায়ই নয়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত আধুনিক একদল শিক্ষকও ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন করে থাকেন। অনেকে ঝিনুকের মতো নীরবে সয়ে যায়। যারা প্রতিবাদ করেছেন তদন্তে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে। যৌন হয়রানিতে পড়ে কেউ কেউ আপস করলেও অনেকে মাথা নত করে না বলে তার প্রাপ্য ফল থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পেশাগত জীবনের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেও কখনোসখনো নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আত্মীয়-পরিজন এমনকি সমাজের নিকটজনদের দ্বারাও নিগৃহীত হয়। বিশ্বস্ত স্বজনদের কাছেও নিপীড়নের শিকার হয়। কেউ মুখ বুজে সহে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে বা প্রলোভনে সমর্পণ করে। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। সমাজে পরিবারে তিরস্কৃত হওয়ার ভয়ে অনেকে সয়ে যায়। নারীকে পুরুষের সঙ্গে লেখাপড়ায় যেমন মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসতে হয়, কর্মক্ষেত্রেও ঘর-সংসার সামলে লড়াই করে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে টিকতে হয়। সমাজ এগিয়েছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। কিন্তু অন্যায়-হয়রানি থামছে না। যে নারী যেখানেই নিগৃহীত হবে সেখানেই যৌন বিকারগ্রস্ত পুরুষের গালে কষে থাপ্পড় দিতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। আইনের আশ্রয় নিতে হবে। জীবন যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধ করেই জয়ী হতে হয়। নীরবে সয়ে গ্লানিতে ডোবার চেয়ে প্রতিবাদী নারীকে সমাজেরও সমীহ করতে হবে। ঘৃণা অপরাধীকে করতে হবে। নিগৃহীতকে নয়। নারীকে আরও জাগ্রত হতে হবে। প্রতিবাদের আগুনে জাগাতে হবে। যৌন বিকৃত একদল পুরুষের জন্য সব পুরুষ গালি খেতে পারে না। একদল লোভী নারীর জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী তার আজন্মের সম্মান যৌন বিকৃত পুরুষের নিপীড়নের শিকার হতে দিতে পারে না। এ প্রতিবাদে পুরুষকেও নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। উপলব্ধি করাতে হবে আঙ্গুল তুলে। পিতা ও স্বামীর সম্মতিতেও তার অধিকার সমান করতে হবে। ধর্মীয় আইনে তাকে দুর্বল রাখা যাবে না। পুরুষ একাই মানুষ নয়, নারীও মানুষ। সমঅধিকার, সমমর্যাদা তার জন্মগত অধিকার। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শুধু নারীবাদীরাই নয়, সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকেই সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নুসরাতের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়ও দেখা গেছে তার গোটা শরীরে ব্যান্ডেজ। বেরিয়ে থাকা পায়ের নখে নেইল পলিশ। একটি তরতাজা গোলাপের মতো সুন্দর আমার, আমাদের মেয়ে নুসরাতের লাশ ছুঁয়ে আজ সকল ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিবাদের ঝড় তুলতে হবে, গণজোয়ারের প্লাবনে ভাসিয়ে দিতে হবে। মালালার জন্য যদি দুনিয়া জাগে, নুসরাতের জন্য কেন দেশ জাগবে না? জাগো মানুষ, জাগো নারী, জাগো পুরুষ, ছাত্রছাত্রী। প্রতিবাদের ঝড় তোল আজ, দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দাও ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কের বিরুদ্ধে। বল, পুরুষ তুমি মানুষ হও। ধর্ষক নয়, যৌন নিপীড়ক নয়, প্রেমিক হও।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর