শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নুসরাত বেঁচে থাকবে প্রতিবাদের আগুন হয়ে

ফরিদা ইয়াসমিন

নুসরাত তার নোটবুকে লিখেছিল, ‘আমি লড়বো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।’ সমাজের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, নারীর প্রতি অসম্মান সব কিছুর প্রতিবাদ করে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে গেছে নুসরাত। একজন শিক্ষকের যৌন সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করে জীবন দিতে হলো নুসরাত জাহান রাফিকে।
নুসরাত একটি প্রতিবাদের নাম। সাহসের নাম। ফুটফুটে পরীর মতো একটি মেয়ে নুসরাত। চোখে ছিল স্বপ্ন। স্বপ্ন নিয়ে যে মাদ্রাসায় সে পড়তে গিয়েছিল তার প্রধানকর্তা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাকে আঘাত দিয়েছে। অপমান করেছে। যৌন সন্ত্রাস করেছে। আমাদের ভাষায় শ্লীলতাহানি করেছে। নুসরাত প্রতিবাদ করেছে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে পুড়িয়ে মারা হলো। নুসরাত বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু এ সমাজ তাকে বাঁচতে দিল না।
সমাজের আনাচে-কানাচে সিরাজ-উদ-দৌলার মতো ঘৃণিত পুরুষ আছে। মহাদাপটের সঙ্গেই আছে। তাই তো শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠলেও তাদের মুক্তির দাবিতে মিছিল হয়। সেই মিছিলের সারিতে দলে দলে নারীও যোগ দেয়। হায়রে নারী! তার নিজের সম্মানটা কোথায় তাও বুঝতে শিখল না। অথবা যারা এই মিছিলে যোগ দিল তারাও হয়তো বাঁচার জন্যই তা করেছে। শত রকমের চাপে হয়তো তাদের অংশ নিতে হয়েছে। তথাকথিত এই শিক্ষকের মুক্তির দাবিতে স্থানীয় প্রভাবশালীরাও অংশ নিয়েছে। একজন কুলাঙ্গারের জন্য সব দল মত এক হয়ে যায়! এই আমার বাংলাদেশ?
ফেনী সোনাগাজীর মাদ্রাসা শিক্ষক সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে অনেক দিন থেকেই শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানিসহ নানা অভিযোগ ছিল। সাহস করে কেউ এভাবে প্রতিবাদ করেনি। কারণ সে সব সময় ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে ছিল। এলাকায় তার দাপট ছিল। কিন্তু নুসরাত এত্তটুকু মেয়ে। প্রতিবাদে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার নোটবুকে সে লিখেছেÑ ‘আমি তাকে শাস্তি দিব। যে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দিব যে তাকে দেখে অন্যরা শিক্ষা নিবে। আমি তাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিব।’ মেয়েটি ও তার পরিবার শত ভয়ভীতির মুখেও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেনি। তারা অবিচল ছিল ন্যায়বিচার পাওয়ার। শত চাপ সত্ত্বেও শিক্ষকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তারা তুলে নেয়নি। সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ মুছে ফেলতে আসামিরা নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বর্বরতম ঘটনা ঘটায়। নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগায়। নুসরাত অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিতে চেয়েছিল। আমরা চাই নুসরাত হত্যায় জড়িতদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে নুসরাত, তনুরা এভাবেই জীবন দেবে? আমরা জানি কুমিল্লার তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। তিন বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে আজ পর্যন্ত তনু হত্যার বিচার হয়নি। নারী শুধু ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির শিকারই হয় না, যখন অপরাধীকে চিনে ফেলে তখনই তাকে খুন করা হয়। তনুর ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছিল, নুসরাতের বেলায় তাই হলো। পার্থক্য নুসরাত কয়েক দিন হাসপাতালে থেকে বাঁচার লড়াইটা করল।
আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি মেয়েই যৌন হয়রানির নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। প্রতিটি মেয়ে নিজের শরীর নিয়ে ভয় ও আতঙ্কে থাকে। রাস্তাঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কখনো কখনো আত্মীয়স্বজন দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে। সব কথা প্রকাশিত হয় না। পরিবার থেকেও শিক্ষা দেওয়া হয় ঘটনা চেপে যাওয়ার। কেউ কেউ বলেন, নারীরা শালীন পোশাক পরলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। কিন্তু নুসরাত তো সব সময়ই শালীন পোশাক পরত, অথবা তনু? তারা তো কেউ অশালীন পোশাক পরেনি। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে মূলত ভাবা হয় সেখানে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রাধান্য থাকে। কিন্তু এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বেলায় আমরা কী দেখলাম! এই শিক্ষক তো নানা অপকর্মে জড়িত ছিল। এটা খুবই দুঃখজনক যে, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে মেয়েটিকে এই সমাজে অপরাধী বলা হয়। সে জন্য অনেক ঘটনা আমাদের সমাজে চেপে যাওয়া হয়। কিন্তু নুসরাত সাহসী বলে এই অমানুষ শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কোনো অবস্থায়ই নতিস্বীকার করেনি। ধন্যবাদ জানাই তার পরিবারকে যারা তার সঙ্গে থেকে এই সাহসকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ এই পরিবারটি কী পেল? সাহসের বিনিময়ে তাদের মেয়েকে হারাতে হলো। এই পরিবারটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কি আমাদের আছে? কী দিয়ে আমরা তাদের সান্ত্বনা দেব?
একে একে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিচার হচ্ছে না। এই সমাজ ধর্ষণ আর যৌন হয়রানির ঘটনাগুলোকে অপরাধই মনে করে না। পুরুষ আধিপত্যের এই সমাজ মনে করে এ রকম একটু আধটু পুরুষরা করতেই পারে। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ শফী প্রকাশ্যে জনসভায় নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘নারীকে দেখলে পুরুষের লোভ হবে। এর ফলে লালসা চরিতার্থ করতেই পারে।’ কিন্তু এ বক্তব্যের জন্য তার কোনো বিচার হয় না। উল্টো নানাভাবে পুরস্কৃত হন। আল্লামা শফীর মতো ইসলামী চিন্তাবিদের(?) বক্তব্যে এ ধরনের অপরাধকে উসকে দেওয়া হয়। কুলাঙ্গাররা উৎসাহী হন।
নুসরাত তার জীবন দিয়ে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে গেছে। সে সমাজকে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এটি কত বড় অন্যায়। কিছু দিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শিশু ধর্ষণের’ ক্ষেত্রে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনে স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু আমরা সব ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাই। ধর্ষণ একটি মানুষকে মানসিক, সামাজিকভাবে খুন করার শামিল। আইনের কঠোর বিধান এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ধর্ষণের উৎসব থামবে না।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চান। সেই লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। মানবিক বাংলাদেশের জন্য বন্ধ করতে হবে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা, নারীকে অসম্মান। ফেনীর সোনাগাজীর ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে নুসরাত তার নোটবুকে লিখেছিল- ‘আমি মরব না, আমি বাঁচব।’ নুসরাত তুমি মরনি, তুমি বেঁচে আছ। বেঁচে আছ প্রতিবাদের আগুন হয়ে, সাহসের প্রতীক হয়ে। তুমি বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : [email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর