শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

আরেক জনপ্রিয় লেখক বুদ্ধদেব গুহ

ইমদাদুল হক মিলন

আরেক জনপ্রিয় লেখক বুদ্ধদেব গুহ

বুদ্ধদেব গুহর ডাকনাম লালা। তাঁর ভক্ত-অনুসারী এবং তরুণ প্রকাশকরা লালাদা বলে ডাকেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সমসাময়িক লেখক। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বরাবরই শীতল। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত তিনি হননি। নিজেকে রেখেছেন আলাদা করে। তাঁর লেখার জগৎ বন-বনানী, অরণ্য-পাহাড় আর আদিবাসী মানুষের জীবন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর গাছপালা, অরণ্য, বনভূমি, মাঠ প্রকৃতি নিয়ে তাঁর মতো করে আর কেউ লেখালেখি করেননি। শিকারপ্রিয় মানুষ। বন্দুক হাতে বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন। ভারতবর্ষের প্রায় সব বন-পাহাড়ে গিয়েছেন। শিকারের আশায় চলে গেছেন সুদূর আফ্রিকায়। আদ্যোপান্ত রোমান্টিক মনের লেখক বুদ্ধদেব গুহ। সম্ভবত তিনি পত্রসাহিত্যের সর্বশেষ লেখক। ব্যক্তিজীবনে চিঠিপত্র লিখতে খুবই পছন্দ করেন। ভক্ত-পাঠকদের চিঠির জবাব দিতেন নিয়মিত। কারও লেখা পড়ে মুগ্ধ হলে সে যত তরুণ-নবীন লেখকই হোক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তাকে চিঠি লিখতেন। কলকাতার কয়েকটি পুজো সংখ্যায় আমার লেখা পড়ে বেশ অনেকগুলো চিঠি তিনি আমাকে লিখেছিলেন। মূলত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির নিজস্ব বিশাল ফার্ম চালিয়েছেন দীর্ঘ জীবন। রাজপুরুষের মতো দেখতে। নিধুবাবুর টকপার অসাধারণ শিল্পী। তাঁর গান যারা শুনেছেন সবাই মুগ্ধ হয়েছেন। স্ত্রী ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ঋতুগুহ। বেশ কয়েক বছর আগে ঋতুগুহ চলে গেছেন। বুদ্ধদেব গুহর বয়স এখন ৮০ ছাড়িয়ে গেছে। লেখালেখি বন্ধ। মেয়েরা তাঁর দেখভাল করছে। স্মৃতিশক্তি সামান্য এলোমেলো হয়েছে। হাঁটাচলা তেমনভাবে করতে পারেন না। আমার প্রকাশক নির্মল বুক এজেন্সি ও সাহিত্যমের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার সাহা বললেন, অতীতের সবকিছু অনুপঙ্খ মনে আছে লালাদার। বর্তমানের অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। এই প্রদীপই বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমি যৌথভাবে ‘দুই বাংলার পঞ্চাশটি প্রেমের গল্প’ নামে বই সম্পাদনা করেছি। সাহিত্যমই বের করেছে। এ পর্যন্ত বোধহয় ১০-১২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের ২৫ জন গল্পকার ও পশ্চিমবঙ্গের ২৫ জন গল্পকার। বুদ্ধদেব গুহ এবং আমি দুজনেই দুটো আলাদা ভূমিকা লিখেছি।

কলকাতার বেশ কয়েকজন নামি লেখকের সঙ্গে যৌথভাবে বই সম্পাদনা করেছি আমি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে করেছি আটটি, শীর্ষেন্দুর সঙ্গে দুটি, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি। সবগুলোরই প্রকাশক নির্মল বুক এজেন্সি। নির্মল সাধারণত ছোটদের বই প্রকাশ করে। বড়দের বইগুলো করে সাহিত্যম নামে। নির্মলের বইয়ের দাম কম। ব্যাপক বিক্রি। আমার ভূতগুলো খুব দুষ্ট ছিল। বইটি শুনেছি হাজার চল্লিশেক কপি বিক্রি করেছে। যৌথ সম্পাদনার বইগুলোও খুবই জনপ্রিয়। প্রতিবছরই একটি দুটো সংস্করণ প্রকাশিত হয়। 

সাহিত্যম থেকে বুদ্ধদেব গুহর অনেকগুলো বই বেরিয়েছে। কলেজে পড়ার সময় থেকে বুদ্ধদেব গুহর লেখা আমি পড়ি। বন-পাহাড় শিকার কাহিনি এসব বিষয়ে লেখার ওপর বিশেষ দুর্বলতা আছে আমার এবং রোমান্টিক লেখার প্রতি তো বটেই। ফলে বুদ্ধদেব গুহর লেখা খুবই মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল আমার। সেই সময়ে তাঁর দুটো উপন্যাস খুবই জনপ্রিয় ছিল। একটি উপন্যাসের নাম ‘কুয়েলের কাছে’, অন্যটি ‘একটু উষ্ণতার জন্য’। আমার মতো বহু পাঠক এই দুটো উপন্যাস পড়ে বুদ্ধদেব গুহর ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর একের পর এক পড়তে শুরু করলাম তাঁর বাবলি, নির্জন, বাতিঘর, দু-নম্বর, নিবেদন ইতি, কোজাঘর, চাপরাশ, মাধুবাড়ি, তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস চারখে র ‘ঋভু’ আর তাঁর ছোটদের উপন্যাসগুলো। কিশোরদের জন্য তিনি একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। সেই চরিত্রের নাম ঋজু দা। ঋজু দা সিরিজের প্রথম বই পড়েছিলাম ‘ঋজু দার সঙ্গে জঙ্গলে’। তাঁর আরেকটি বইয়ের নাম ‘ওয়াইকিকি’। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বেরিয়েছিল পাঁচ খে র ‘বুদ্ধদেব গুহর ছোটগল্প’। কোজাঘর উপন্যাসে অনেকগুলো বাঁশের নাম ছিল। এই বই পড়ার আগে জানতামই না এত বাঁশ আছে আর মাধুবাড়ি পড়ে তো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থেকেছি অনেক দিন। এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল দেশ পত্রিকায়। তখন দেশ ছিল সাপ্তাহিক। এক পর্ব পড়ে অন্য পর্বের জন্য গভীর অপেক্ষায় থাকতাম। যখন বই হয়ে বেরোল আনন্দ পাবলিশার্স থেকে তখন আবার পড়লাম। একত্রে এত বড় উপন্যাসটি পড়ার মজাই ছিল আলাদা।

বুদ্ধদেব গুহর প্রথম উপন্যাস ‘হলুদ বসন্ত’। নায়িকার নাম ছিল নয়না চৌধুরী। দেশ বা আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। তখন আনন্দবাজারের বাংলা সাহিত্যের এক কর্ণধার সন্তোষ কুমার ঘোষ ‘হলুদ বসন্ত’ পড়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং লেখার জগতে লেগে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বুদ্ধদেব গুহকে। সন্তোষ কুমার ঘোষের প্রেরণাতেই অনেকের প্রিয় লালাদা বুদ্ধদেব গুহ হয়ে উঠলেন।  বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে পরিচয় হলো নব্বই সালের দিকে। এক দুপুরে তাঁর অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রদীপ। পুরনো আমলের নিজস্ব ভবনে তাঁর অফিস। সুন্দর রুমে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসেছিলেন। অতি প্রাণখোলা মানুষ। মুহূর্তে আপন করে নিলেন আমাকে। চমৎকার টেবিলে কলমদানিতে অনেক দামি দামি সুন্দর কলম সাজানো। প্রথমেই সেখান থেকে একটি সোনালি কলম নিয়ে আমার হাতে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, তোমার হাতে সোনার কলম তুলে দিলাম। তারপর শুরু হলো আমাদের গল্প। দামি সুন্দর কাপে চা, বিস্কুট আর গল্প। একটা পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, একি, তুমি দেখি আমাদের ভাষায় কথা বলছ? আমি বললাম, আমি তো বাংলা ভাষায় কথা বলছি। তিনি বললেন, আমি তো জানি বাংলাদেশের মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। শুনে আমি হেসেছিলাম। সবাই বলে না। মূল বাংলা ভাষাটা তো একই। যিনি যে অঞ্চলের মানুষ তিনি হয়তো বাড়িতে বা আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সেই অঞ্চলের ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু অন্যত্র শুদ্ধ বাংলাতেই বলেন। আঞ্চলিকতার কথা যদি বলেন তাহলে তো পশ্চিমবঙ্গেও সেই অবস্থা। এখানেও এলুম গেলুম চলছে। এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি হলো। তারপর তিনি আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন বড় একটি রেস্টুরেন্টে। প্রায় সারাটা দিন আমরা একসঙ্গে কাটালাম। সেই দিনটির কথা খুব মনে পড়ে। এরপর কলকাতা গেলেই তাঁর সঙ্গে কোনো না কোনো দিন দেখা হতো, আড্ডা হতো। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘রি-ইউনিয়ন’ উপন্যাসটি তিনি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। এ আমার জন্য খুবই সম্মানের ঘটনা। বুদ্ধদেব গুহর জনপ্রিয়তায় এখন একটু ভাটা পড়েছে। তাতে কিছু যায় আসে না। পৃথিবীর খুব কম লেখকই সবসময় একরকম জনপ্রিয় থাকেন। কারও কারও জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ে। কারও কারও কমে। এটাই নিয়ম। তবে বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে বুদ্ধদেব গুহর অবদান খুব কম নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর