রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঠিকানায় মিলছে না সাক্ষী

দেড় যুগেও বিচার শেষ হয়নি রমনা বটমূলে বোমা হামলার, হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষা

আরাফাত মুন্না ও তুহিন হাওলাদার

দেড় যুগ আগে রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান নয়জন। হাসপাতালে আরও একজন মারা যান। নির্মম এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা দুটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে হাই কোর্টে। আর বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটি থমকে আছে সাক্ষীর অভাবে। গত এক বছরে একজন সাক্ষীও হাজির করতে পারেনি প্রসিকিউশন পক্ষ। এ ছাড়া পলাতক চার আসামির হদিস মেলেনি এত বছরেও। এ কারণে বিচার শেষ হওয়া নিয়ে উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ছে সংশ্লিষ্টদের। মামলাসংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তা বলছেন, সাক্ষীদের ঠিকানায় গিয়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আদালত থেকে দফায় দফায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নথিতে থাকা ঠিকানায় গিয়ে সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আদালতসূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। মামলার মোট ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এখনো ৫৯ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ঠিক থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে না পারায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। আগামী ২৯ এপ্রিলও এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। জানতে চাইলে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবু আবদুল্লাহ ভূইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একই ঘটনার হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার পর সাক্ষীরা আর আদালতে আসতে চাচ্ছেন না। ব্যক্তিগতভাবে তাদের টেলিফোন করে আদালতে আসতে বললেও তারা “দারুণ রকম অনীহা” প্রকাশ করছেন।’ তিনি বলেন, ‘এত বছর আগের এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে সব মিলে ২৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতের নজরে আনা হলে বিচারক বাকি সাক্ষীদের হাজির করাতে গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যুর আদেশ দিয়েছেন। এসব সাক্ষীর মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশও রয়েছে। পুলিশ নথিতে থাকা সাক্ষীদের ঠিকানায় গিয়ে তাদের খুঁজে পাচ্ছে না।’ তাই কোনোভাবেই তাদের আদালতে আনা যাচ্ছে না বলে জানান সরকারি এই আইনজীবী। এত বছর ধীরগতি থাকলেও বছরখানেকের মধ্যেই মামলাটি নিষ্পত্তির আশা তার। এদিকে ২০১৪ সালের ২৩ জুন বিচারিক আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করে। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য মামলাটি হাই কোর্টে আসে। এরপর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি শহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স শুনানি সমাপনী পর্যায়ে আসার পর এ আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হয়ে যায়। পরে মামলাটি পাঠানো হয় হাই কোর্টের অন্য একটি বেঞ্চের কার্যতালিকায়। এ বেঞ্চও মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এখন চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতে রায় হওয়ার পর হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে এসেছে। একই সঙ্গে জেল আপিল ও নিয়মিত আপিলও দায়ের হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ এ মামলাটি দ্রুত শুনানির জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি শিগগিরই ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তি হবে।’ দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু আক্ষেপ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চোখের সামনে মানুষ মারা গেল, রক্তে ভিজে গেল আমার গায়ের পোশাক, সেই ঘটনার বিচার আজও দেখতে পারলাম না, এটাই আফসোস।’ তিনি বলেন, ‘এ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তা এবং বিচারককে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। প্রয়োজনে সপ্তাহে দু-তিন দিন করে তারিখ নির্ধারণ করে বিচারটি শেষ করতে হবে। হাই কোর্টেও দ্রুত ডেথ রেফারেন্স শুনানির উদ্যোগ গ্রহণের দাবি তার। মামলার নথিসূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রুহুল আমিন বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদ  দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদ  দেওয়া হয় ছয় আসামিকে। মৃত্যুদ  ও যাবজ্জীবন কারাদ প্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদ ও দিয়েছে আদালত। এ মামলায় ১৪ আসামির মধ্যে চারজন শুরু থেকেই পলাতক। বাকিরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। এসব আসামির মধ্যে সিলেটে ২০০৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার মামলায় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল মৃত্যুদ  কার্যকর হয়েছে মুফতি হান্নানের। পলাতক আসামিরা হলেন মাওলানা মো. তাজউদ্দিন আহমদ, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান শফিক ও মুফতি আবদুল হাই। মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। ঘটনার প্রায় আট বছর পর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আলোচিত এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বার বার পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, বার বার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণে বিচার শুরু হতে দেরি হয়। পর্যায়ক্রমে থানা, ডিবি ও সিআইডি পুলিশে মামলার তদন্ত যায়। মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়। পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছরের ১৬ এপ্রিল পৃথক মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর