রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্বাগত ১৪২৬

প্রাণের পয়লা বৈশাখ

মাহমুদ হাসান

স্বাগত ১৪২৬

কখনো মেঘবৃষ্টিঝড়, কখনো গ্রীষ্মবর্ষাশীত -- এক অচেনা চৈত্রমাস পেরিয়ে আজ এসেছে পয়লা বৈশাখ, বাঙালির নববর্ষ। শুভ নববর্ষ ১৪২৬। গতকাল শেষ চৈত্রের বিকেলে বর্ষবিদায়ের সব নাগরিক আয়োজন ধুয়েমুছে নিয়ে গেছে অকাল বর্ষণ। তাতে কী, যানজট কোলাহল দূষণের কষ্ট ছাপিয়ে এ মহানগর প্রতীক্ষায় থাকে পয়লা বৈশাখের আনন্দ-উৎসবের। এ শহরের মানুষ অনেক কৌতূহলী, রাস্তায় কিছু ঘটলে কাজ ফেলে ভিড় জমায়, আগুন দেখতে মানুষের স্রোত নামে। তারপরও অন্যরকম এক মেজাজে বৈশাখের প্রথম ভোরে ঘুমভাঙা চোখে পথে নামে এ শহর, পথে নামে শহরের মানুষেরা, শুভযাত্রা শুরু করে স্বপ্নময় নতুন বছর। পয়লা বৈশাখের দিনটা বছরের অন্য দিনগুলোর চেয়ে তাই অন্যরকম। প্রত্যাশার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে থাকে চারদিক। খবরের কাগজ যেমন প্রতিদিন সুখবর দেয়, দুঃসংবাদ দেয়, অর্জনের এবং স্বপ্নের খবর দেয়, তেমনি নতুন বছর ঘিরে আমাদের কত আশা থাকে, কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা। নতুন বছর আমাদের উন্নতির খবর দেবে, তৃপ্তির খবর দেবে, আমাদের রূপান্তরের গল্প হবে। শুভ ও কল্যাণ কামনায় ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, সবাই আজ একমন হয়ে নববর্ষ বরণ করবে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বর্ণিল উৎসবে মেতে উঠবে মনপ্রাণ। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সুন্দরের জয়গানে প্রাণে প্রাণে লাগবে শুভকল্যাণের দোলা। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’।

দেহের সঙ্গে নিঃশ্বাসের যে সম্পর্ক, বাঙালি ও পয়লা বৈশাখের সেই সম্পর্ক। পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশের চিরন্তন উৎসব, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পয়লা বৈশাখ আমাদের আপন শিকড়ের প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হওয়ার দিন। পয়লা বৈশাখে আবহমান লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যে বর্ষবরণ উৎসবে মেতে ওঠে শহর-গ্রাম-নগর-বন্দর। রাজধানীতে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান রমনা বটমূল ছাড়িয়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে নগরজুড়ে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঢাকা পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। বর্ষবরণের আনন্দ-উৎসবে মুখরিত থাকে সমগ্র দেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া আকাশে বাতাসে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয় ‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি...’ । নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি।

ঢাকায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ সূর্যোদয়ের সময় রমনা বটমূলে ছায়ানটের, শাহবাগে ঋষিজের এবং শেরেবাংলানগরে সুরের ধারার শিল্পীদের বৃন্দসংগীত ‘এসো, এসো হে বৈশাখ...’। এ ছাড়া শাহবাগে চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, পুরান ঢাকায় হালখাতা, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর, বসুন্ধরা, উত্তরা, বনশ্রী, বনানী ও গুলশানসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বৈশাখী মেলায় ঢাকা পরিণত হয় আনন্দ নগরীতে। বাংলা নববর্ষ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে খই-মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা মিষ্টান্নের পাশাপাশি ঘরে ঘরে হরেক রকম খাবার। খাদ্যরসিকদের মিলনমেলায় পরিণত হবে নগরীর হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফুডকোর্টগুলো।

বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক ও হালখাতার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সেকালে গ্রামবাংলায় নিভৃত পল্লীর অশ্বত্থ তলে নদীতীরে বসত বৈশাখী মেলা। শহরে-গঞ্জে হালখাতা হতো ছোট-বড় প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। মিষ্টান্ন ছিল নববর্ষের অনুষঙ্গ। সারা দেশে আয়োজন করা হতো চৈত্রসংক্রান্তির পালপার্বণ, নাগরদোলা, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, কুস্তি, গান-বাজনা, খেলাধুলা, প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি। এখন দিনবদলের পালায় নগর জীবনে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয় নাগরিক আয়োজনে। সারা দেশে মঙ্গলসংগীত ও শোভাযাত্রা, হালখাতা, মিষ্টিমুখ, নতুন কাপড়, ভূরিভোজ, বৈশাখী মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি পয়লা বৈশাখকে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে; শহরে-নগরে-পল্লীতে বাংলা নববর্ষ আসে সাড়ম্বরে। কিন্তু পয়লা ফাল্গুন, পয়লা অগ্রহায়ণের মতো দু-একটা দিন-তারিখ ছাড়া সারা বছর বাংলা সনের মাস-তারিখের তেমন একটা খোঁজ রাখা হয় না। অবশ্য পল্লীগ্রামে কৃষিকাজে বাংলা সনের গুরুত্ব এখনো অপরিসীম। নিত্যজীবনে বছরজুড়ে খ্রিস্টীয় বর্ষ অনুসরণ করা হলেও বঙ্গাব্দের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ তবু আমাদের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা। ভবিষতে কী হবে কেউ বলতে পারে না, তবু ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হয়ই। বর্তমানের পরিধিটা বাড়ালে ভবিষ্যৎ তখন সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে বন্দী থাকে না, মুক্ত থাকে, মুক্ত হয়, মুক্তিবুদ্ধির পথ সুগম হয়। ভবিষ্যতে মুক্তবুদ্ধির পথ মুক্ত কর হে বৈশাখ।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এইচ এম এরশাদ প্রমুখ পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর