রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্ষোভ-বিক্ষোভ মানববন্ধন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকার রাজপথসহ সারা দেশে নুসরাত হত্যার দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন শত শত প্রতিবাদী মানুষ। রাজধানীতে বঙ্গভবন থেকে গণভবন পর্যন্ত ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাশিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে বাংলাশে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।

গতকাল বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত পূর্বনির্ধারিত এই কর্মসূচিতে আগামী ২০ থেকে ২৭ এপ্রিল দেশব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সপ্তাহ পালনের ডাক দেয় সংগঠনটি। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচিতে সিপিবি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বাম ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নারী অধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন এনজিওর পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। বঙ্গভবন থেকে গণভবন পর্যন্ত আয়োজিত মানববন্ধনের পথ ধরা হয় রাজউক ভবন-দৈনিক বাংলার মোড়, পল্টন মোড়, প্রেস ক্লাব, হাই কোর্ট, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, শাহবাগ, কাঁটাবন, বাটা সিগন্যাল, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এবং কলাবাগান হয়ে আসাদ গেট। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, ডিরেক্টর গিল্ডস, জাতীয় নারী মুক্তি কাউন্সিল ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিসহ নানা সংগঠন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গভবনের পাশে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ফটকের সামনে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে মানববন্ধন করা হয়। এতে অংশ নেন সিপিবির নেতা-কর্মী ছাড়াও হকার্স ইউনিয়ন এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়নের অর্ধশত নেতা-কর্মী। পল্টন মোড়ে এল মল্লিক কমপ্লেক্সের সামনে মানববন্ধন করেন সিপিবির ব্যানারে প্রায় ৩০ জন নেতা-কমী। এ সময় ‘ইয়াসমীন, সাগর-রুনি, তনু, ত্বকী, নুসরাত-এর শেষ কোথায়?’ লেখা-সংবলিত প্লাকার্ড বহন করতে দেখা যায়। এর উল্টো দিকে একই দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে আরেকটি সংগঠন। বিক্ষোভে তারা ‘ফ্যাসিবাদী শাসন উচ্ছেদে ঐক্যবদ্ধ হোন, সাগর-রুনি, তনু, কৃত্তিকাসহ সব হত্যা-ধর্ষণের বিচার চাই, নারীবিদ্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, নুসরাত হত্যার বিচার চাই’সহ নানা স্লোগান লেখা প্লাকার্ড ব্যবহার করে। আসাদ গেটের মানববন্ধনে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, টিআইবি, নারীপক্ষ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর ও কৃষিবিদ ইউনিয়নসহ অন্তত ১২টি সংগঠন যোগ দেয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সিপিবি, ফেনী সমিতি, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন করে। এই মানববন্ধনে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনার পেছনে কারা আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। এই হত্যাকা  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার চক্রান্ত। এ সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি, জাতীয় পার্টির নাজমা আখতার এমপি, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদ নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ, ফেনী সমিতির সভাপতি শেখ আবদুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। আসাদ গেটের মানববন্ধনে অংশ নেয় কাফরুল থানা শাখার সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন, মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা শাখার ছাত্র ইউনিয়ন, নারী প্রগতি সংঘ, মোহাম্মদপুর থানা শাখার উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ঘাসফড়িং খেলাঘর আসর, ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টস ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, আনন্দদ্যুতি খেলাঘর আসর, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, টিআইবি, নারীপক্ষ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, কৃষিবিদ ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। বঙ্গভবনের মুখে রাজউকের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘এই আন্দোলন শুধু সিপিবির নয়, এটা সব দলের আন্দোলন। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন শেষ হবে না। নুসরাত বলেছিল, আমার জীবন চলে যেতে পারে কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাব। নুসরাতের এই আহ্বান ১৬ কোটি মানুষ গ্রহণ করেছে। মানুষ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এই হত্যাকা ।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধীরা জানে, সরকারি দলে থাকলে কোনো অপরাধের বিচার হয় না। বর্তমান সরকার ভোটের নামে প্রহসন করেছে। নির্বাচনের আগের দিন ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। যারা এই কাজে সহায়তা করেছে তাদের পুরস্কার অবাধে লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ। সবকিছু বাণিজ্যিক হচ্ছে। কেনাবেচা হচ্ছে। অপরাধ, নৈরাজ্য, খুন, ধর্ষণে ভরে গেছে। ধ্বংস, অবক্ষয়, বিভীষিকাময় অবস্থায় দাঁড়িয়েছে দেশ। চলছে লুটপাটের রাজত্ব। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনলে ফের অপরাধ করার সাহস কেউ দেখাত না।’ সোনাগাজী থানার ওসিকে গ্রেফতার করা এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। আসাদ গেটে আয়োজিত মানববন্ধনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা নুসরাত হত্যার ন্যায়বিচার চাই। এই ঘটনার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এ ঘটনার কঠোর শাস্তি দেওয়া সরকারের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা।’ এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘নুসরাতের বিচার করতে সরকার যে ঘোষণা দিয়েছে, তা যেন কথার কথা না হয়। আমরা আইনের শাসন দেখতে চাই।’ সিপিবির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বলেন, ‘নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। তনু হত্যার পরও বাংলাদেশ জেগেছিল। তবু সে ঘটনার বিচার হয়নি।’ সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ সরকার বলেন, ছয় সন্তানের জননী থেকে শিশু- কেউ ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বেশির ভাগ ঘটনায় তদন্ত কমিটির নামে বিষয়টিকে হালকা করে ফেলা হয়। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির বলেন, নারী-পুরুষ সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে না। আনন্দদ্যুতি খেলাঘর আসরের সভাপতি লাবনী শবনম মুক্তি বলেন, ‘নুসরাতের মুখে আমার মেয়ের মুখ দেখতে পাই। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আজ এমন পরিবেশ হয়েছে। নুসরাত হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের মানববন্ধনে গবেষক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। নুসরাত হত্যার দ্রুত বিচারসহ পূর্বে এ ধরনের সবগুলো ঘটনার বিচার করতে হবে।’ সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি হলো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে রাস্তায় নামা। তারপর একসময় সব ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। নুসরাতের মতো যাতে আর কোনো ঘটনা না ঘটে, এর জন্য আমরা এই ঘটনাসহ সবগুলো নারী সহিংসতায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি চাই।’ বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- দিনাজপুর : দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, নারী মুক্তি সংসদ, যুব মৈত্রী, ছাত্র মৈত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টি।

বরিশাল : নগরীর সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হলের সামনে পৃথক মানববন্ধন করে বরিশাল সম্মিলিত নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন এবং ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও গণনাট্য সংস্থা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের গণজাগরণ মঞ্চের সামনে ‘জাগো নারী বহ্নি শিখার’ ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন।

ঝিনাইদহ : শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে মানববন্ধনের আয়োজন করে সরকারি কেসি কলেজ ছাত্রলীগ। এতে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়।

ফরিদপুর : নুসরাত হত্যার বিচারের দাবিতে ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সামনেও মানববন্ধন করা হয়। ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনে ফরিদপুরের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

পঞ্চগড় : দুপুরে বোদা উপজেলায় মানববন্ধন করে শাখা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের সোনালী ব্যাংকের সামনে অনুষ্ঠিত ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনে অবিলম্বে নুসরাত হত্যায় জড়িতদের ফাঁসির দাবি করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সামনে ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন স্টুডেন্ট উইং ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামের একটি সংগঠন মানববন্ধন করে। বিকালে সচেতন যুবসমাজের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হয়।

নেত্রকোনা : শহরের মোক্তারপাড়া পৌরসভার মোড়ে মানববন্ধন করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এ সময় বক্তারা নুসরাত হত্যায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

সর্বশেষ খবর