রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বৈশাখী উৎসবে একজন সন্‌জীদা

জিন্নাতুন নূর

বৈশাখী উৎসবে একজন সন্‌জীদা

বাঙালির চিরন্তন বৈশাখী উৎসবকে সার্বজনীন করতে প্রশংসিত ভূমিকা রেখেছেন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি সন্জীদা খাতুন। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মোট পাঁচ দশকেরও বেশি সময় দেশে এই পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়েই বৈশাখী  উৎসবের শুরু হয়। এ জন্য রমনার বটমূলে আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের। দল-মত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে শামিল করে একজন সন্জীদা খাতুন ছায়ানটের আয়োজনটির মধ্য দিয়ে বৈশাখী উৎসবকে এগিয়ে নিয়ে চলছেন। সাংস্কৃৃতিক বোদ্ধারা মনে করেন সন্জীদা খাতুন একজন লড়াকু সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। তার দায়িত্বের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি সংস্কৃতি পুনর্জাগরণের যে মহৎ কাজটি করছেন, তার এই অসামান্য অবদানের জন্য তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা উচিত। প্রাবন্ধিক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালিরা নিজেদের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা এবং সব সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণে সার্বজনীন একটি উৎসব হিসেবে পয়লা বৈশাখের উৎসব পালনে তার গুরুত্ব বাড়ে। আর সাংস্কৃৃতিক প্রতিরোধের জায়গা থেকে ছায়ানট এই উৎসবকে গুরুত্ব দেয়। আর ছায়ানটের সংগীতের মাধ্যমে বর্ষবরণ করার এই পদ্ধতিকেও সাধারণ মানুষ সাদরে গ্রহণ করল। এরপর যদিও ব্যবসায়ীরা এর মধ্যে পান্তা-ইলিশের ব্যবসা ঢুকিয়ে দিল। আমি মনে করি পয়লা বৈশাখের উৎসব আয়োজন সন্জীদা আপা যে ভূমিকা পালন করেছেন এ জন্য তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া উচিত। এই উৎসব আমাদেরকে এক করে রাখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বেগম আক্তার কামাল বলেন, সন্জীদা আপা হচ্ছেন একজন লড়াকু সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ। তার দেখানো পথেই ছায়ানটকে কেন্দ্র করে ভোরে সূর্যোদয়ের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই উৎসব অসাধারণ। এই উৎসব আমাদের জন্য পরম পাওয়া। একে কেন্দ্র করে অর্থনীতি গতি পায়। আবার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের এই বাঙালি সংস্কৃতি গ্রাম ও শহরের মধ্যে মানুষের বিভেদ মুছে দেয়। আর এর পেছনে যার অবদান অন্যতম তিনি হলেন সন্জীদা খাতুন। আমার দৃষ্টিতে তিনি মহামানবের ভূমিকা পালন করছেন। সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশ আজ ঐক্যবদ্ধ হবে। জঙ্গিবাদের বিষাক্ত ছোবল উপেক্ষা করে বাঙালি আজ তার সংস্কৃৃতি ও ঐতিহ্যের জয়গান করবেন। কীভাবে শুরু হয়েছিল বাঙালির এই আনন্দ উৎসব? তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তা জানতে হবে। এ জন্য ফিরে যেতে হবে ষাটের দশকে। সে সময় দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি সন্জীদা খাতুনসহ সমকালীন অন্যদের প্রচেষ্ঠায় নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এই উৎসব পালনে প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের অবদানও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। সন্জীদা খাতুনের ভাষ্যে, আনুষ্ঠানিকভাবে রমনায় প্রথম ১৯৬৭ সালে পয়লা বৈশাখ পালন করা হয়। কিন্তু এর আগে ঢাকার ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলের সঙ্গে সরু একটা জায়গায় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে প্রথম বর্ষবরণ পালন করেন সন্জীদা খাতুনরা। সেটি ছিল স্কুলটির বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান। ১৯৬৩ সালে শুরু হওয়া স্কুলটির প্রথম অনুষ্ঠান পালন করা হয় ’৬৪ সালে। সে সময় স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কিছু নববর্ষের গানও ছিল। ’৬৫-তে ঈদুল আজহায় কোনো অনুষ্ঠান পালন করা হয়নি। পরের বছর আবার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হল। কিন্তু বন্ধুদের কাছ থেকে স্কুলের অনুষ্ঠান আয়োজনের বদলে নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য অনুরোধ করা হলো। এরপর থেকে তারা অনুধাবন করেন যে, পয়লা বৈশাখ বাঙালি জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর যেহেতু সে সময় বাঙালিদের পাকিস্তানি মুসলমান বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল ছায়ানটের সংগঠকরা তা মানতে নারাজ ছিল। তাদের কাছে ধর্মের পরিচয়ের চেয়ে বাঙালি হওয়াটাই ছিল বড় পরিচয়। আর এভাবেই ’৬৭ সালে শহরে বৈশাখ পালনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সে সময় ড. নওয়াজেশ আহমেদ তাদের রমনায় জায়গা দেখিয়ে সেখানে বৈশাখের আয়োজন করলে ভালো হবে বলে জানান। আর এরপর থেকে সেখানে পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। সে হিসেবে ’৬৭ সাল থেকে শুরু হওয়া বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের এবার ৫২ বছরে পা দিচ্ছে। তবে রমনায় বটমূলের গাছকে বটগাছ বলা হলেও গাছটি কিন্তু অশ্বথ। বটমূল বলার পিছে আয়োজকদের যুক্তি ছিল। আর তা হলো-অশ্বথ বা বটতলা বললে একটা আঞ্চলিক ভাব আসায় সংগঠকের নামকরণ করেন বটমূল। আর এই বটমূলের কাছ ঘেঁষে তাদের অনুষ্ঠান বসত, আগত দর্শকদের ঘেঁষে বসত অনেক দোকান। সেখানে পান্তা-ইলিশ খাওয়ানো হতো। আর তখন এই কাজটা করত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তবে গ্রামের মানুষের নববর্ষ আর শহরের নববর্ষের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। ঢাকায় রমনায় যে পয়লা বৈশাখের আয়োজন করা হয় তা বাঙালি জাতির জাগরণের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। সেটিকে সময়ের ধারাবাহিকতায় ছায়ানট নেতৃত্ব বড় করে তুলে ধরেছেন। তবে ভিতরে ব্যবসায়িক দোকানপাট বসায় অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। আয়োজকরা সরকারের কাছে তখন ভিতরে দোকান না বসানোর জন্য অনুরোধ করেন। আর সরকারও তা মেনে নেয়। এরপর দোকানগুলো অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে চলে গিয়েছিল।

সর্বশেষ খবর