মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

শ্রীলঙ্কাকে অস্থিতীশীল করতেই এই হামলা

জিন্নাতুন নূর

শ্রীলঙ্কাকে অস্থিতীশীল করতেই এই হামলা

লে. জে. (অব.) মো. মইনুল ইসলাম

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্যই আন্তর্জাতিক একটি শক্তি এ হামলা চালিয়েছে। শ্রীলঙ্কার এ সিরিজ বোমা হামলা সম্পর্কে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলাম এ মন্তব্য করেন। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে চীনের প্রেসার সরানোর জন্যই এ হামলা চালানো হয়েছে। মইনুল ইসলাম বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময় বিশ্বের সুপার পাওয়ারের একটি ছিল। সেই শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র এখন ক্ষয়িষ্ণুর পথে। এখন সে অর্থে পৃথিবীর অন্য দেশগুলো আর যুক্তরাষ্ট্রের কথা শোনেও না, মানেও না। আর বর্তমান পৃথিবীতে চীনের যে শক্তি তা অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে চীনের অর্থনৈতিক শক্তি এবং অন্যান্য দেশের ওপর চীনের প্রভাব, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের সঙ্গেও দেশটির সুসম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় বহু বছর আগেই গৃহযুদ্ধ শেষ হয়েছে। এর আগে শ্রীলঙ্কায় যারা লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই)-এর সঙ্গে জড়িত ছিল তারা ভারত ও ইসরায়েলের সমর্থক ছিল। এবারের হামলাকারীদের সঙ্গে আগের এলটিটিই-গোষ্ঠীর সম্পর্ক থাকতেই পারে। আমার মনে হচ্ছে এটি শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় নয়। শ্রীলঙ্কার মধ্যে কিছু কিছু সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে এমন ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটে। এটা যে কোনো সমাজেই ঘটতে পারে। যেমন মুসলিমদের ওপর হামলা, চার্চে হামলা এ ধরনের হামলা বিশ্বব্যাপী চলবেই। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক হামলার মতো একই সময়ে এতগুলো স্থানে হামলার ঘটনায় শুধু একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ জড়িত এমন নয়, এটি আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ বলেও আমি মনে করি। বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক বলেন, আমরা জানি যে শ্রীলঙ্কায় চীনের সহযোগিতায় একটি পোর্ট হচ্ছিল। আর সেই পোর্ট নির্মাণের কারণে ভারত শ্রীলঙ্কার ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিল। এজন্য ভারতীয় কন্ট্রাক্টরদের পোর্ট নির্মাণের জন্য কাজও দেওয়া হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে যে, ভারত বিশ্বব্যাপী যে ‘মাতবর’-এর কাজ করত সে জায়গা থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চীনের প্রভাবও ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার ওপর তৈরি হচ্ছে। আবার পাকিস্তান, মিয়ানমারেও সি পোর্ট তৈরি করেছে চীন। শ্রীলঙ্কায় সি পোর্ট তৈরি করছে চীন আর বাংলাদেশেও করার কথা ছিল। সুতরাং ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের যে বলয় তৈরির কথা তাকে হুমকির মুখে ফেলতেই এ হামলা চালানো হতে পারে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এ হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। আমি মনে করি জাতিগতভাবে শ্রীলঙ্কার ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করতেই কোনো একটি গোষ্ঠী এ হামলা চালিয়েছে। আর এটি আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। তার পরও বোমা হামলা নানাভাবে করা হয়। সুইসাইড বোম্বার নিজেও জানে না যে কোথায় কীভাবে তা বিস্ফোরণ করানো হচ্ছে। আমি মনে করি শ্রীলঙ্কায় কোনো গোষ্ঠীর এমন ঘটনা ঘটেনি যে একসঙ্গে এতগুলো স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে।

আমরা চাই এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই থাকুক এবং জাতিগতভাবে আমরা সহাবস্থান করতে চাই। তিনি বলেন, ইস্টার সানডেতে একই সঙ্গে গির্জা ও পাঁচ তারকা হোটেলগুলোয় হামলার মধ্য দিয়ে হামলাকারীরা এর মাধ্যমে জাতিগত যে বিদ্বেষ বুদ্ধিস্ট, মুসলিম, হিন্দুস- তা আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষদের ওপর এ হামলার দোষ চাপাবে।

সব ঘটনা যদি একসূত্রে গাঁথি তাহলে মনে হবে এক ধরনের মুসলিমবিদ্বেষী ন্যারেটিভস তৈরি করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। এতে অন্য সুপার পাওয়ারগুলো জড়িত থাকবে না; ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলো তখন প্রতিশোধ নেবে। অর্থাৎ বিরাট একটি অস্থিরতা সৃষ্টির জন্যই এ হামলা। কারণ যে কোনো অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তা বিরাট বাধা। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কিছুটা চেষ্টা করছে। পৃথিবীতে মুসলিমবিদ্বেষী যে ন্যারেটিভস আছে তাকে আবার নাড়াচাড়া দেওয়া হলো। আবার মুসলিম যে সংগঠন এ হামলার দায় স্বীকার করেছে সেগুলোর ভরণপোষণ করে বাইরের লোকেরা। এগুলো এক ধরনের গৃহপালিত সংগঠন। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের পর পর্যটন খাত থেকে আয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য এবার পাঁচ তারকা হোটেলগুলোয় হামলা চালানো হয়েছে। পর্যটকদের ওপর হামলা করলে দেশটির পর্যটনশিল্পে ধস নামবে। আবার পোর্ট নির্মাণ হলে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এখানে আসবে, দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হবে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কাকে নতজানু করার জন্যই এ হামলা। এর সঙ্গে চীনের প্রভাব ও শ্রীলঙ্কাকে অস্থিতিশীল করার জন্য হামলা চালানো হতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা সবাই যদি দায়িত্বশীল হন এবং নিজেদের জনগণের কথা চিন্তা করেন, এ বিষয়ে সজাগ থাকেন তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে। এরই মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে অনেকে টেররিজমের দোহাই দিয়ে নিজেদের কাজ চালাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শব্দটি টেররিজমের সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে। এ হামলার পর বাংলাদেশেও হামলার ঝুঁকি আছে। সুতরাং রাষ্ট্রনায়কদের এ বিষয়ে আলোচনা করে বিষয়টিকে কুল ডাউন করতে হবে। শ্রীলঙ্কা নিজেদের সামলে উঠুক আর বাংলাদেশও নিজেদের সুরক্ষিত রাখুক। তা না হলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব।

সর্বশেষ খবর