শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিজ ঘরে পরবাসী উখিয়া-টেকনাফবাসী

স্থানীয় পাঁচ লাখ, রোহিঙ্গা ১২ লাখ, ফসলি জমি ফলের গাছ গবাদিপশু থাকছে না কিছু
রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে, বললেন ইউএনএইচসিআর প্রধান

মির্জা মেহেদী তমাল, কক্সবাজার থেকে ফিরে

দেড় বছর আগে রোহিঙ্গারা যখন নতুন করে বাংলাদেশে আসতে থাকে, তখন শিউলি বেগম তার নিজ বাড়ির উঠানেই জায়গা দিয়েছিলেন একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে। পাশাপাশি বাড়ির বাইরে নিজের জায়গায় রোহিঙ্গাদের অন্তত ৭০টি ঘর তুলতে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শিউলি বেগমের মনে এখন শঙ্কা ভর করেছে, তাদের বসত ভিটা আদৌ ফিরে পাবেন কি-না। শিউলি বেগম বলেন, ‘ওরা বেশি দিন থাকবে না- এটা মনে করেই জায়গা দিয়েছিলাম। এখন তো ফেরত যাচ্ছে না। চলে যাওয়ার কথা বলতেই ওরা বলে, আমরা কোথায় যাব? এখানে ঘর তুলেছি। আবাদ করছি। যাওয়ার কথা বলবেন না আর।’ উখিয়ার বালুখালী পাহাড়ের বাসিন্দা শিউলি বেগম এদেরকে আর রাখতে চান না। তিনি বলেন, ‘এরা অর্ধেক ভালো তো অর্ধেক খারাপ। ওদের জনসংখ্যাও বেশি। কিছু বললে দা-বঁটি নিয়ে তেড়ে আসে। মারতে চায়। ভয়ে আমরা ঘরের ভিতর বসে থাকি।’ রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে ফসলি জমি হারিয়েছেন সবুজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমাদের জমির যেগুলো এখনো বাকি আছে, সেখানে আগের মতো ফলন আর হয় না। জমির পাশেই রোহিঙ্গাদের টয়লেট, গোসলখানা। ওদের মানুষ বেশি, চাষের জমিতেই ময়লা ফেলে। আগে বছরে ১ লাখ টাকার আম বিক্রি করতাম। গতবার আম পাকার আগেই সবাই খেয়ে ফেলল। এবার তো আম গাছ কেটে নিয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের থাকতে দিয়ে নিজের চাষের জমির সিংহভাগই হারিয়েছেন কৃষক সবুজ মিয়া। তিনি বলেন, এখানকার গৃহিণীরা আগের মতো আর গরু-ছাগল পালন করতে পারছেন না। উখিয়ার মধুরছড়ায় রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে আবুল কালাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা ও তাঁর স্বজনদের কয়েকটি বাড়ি পড়েছে। তিনি জানান, যে জমিগুলোতে তাঁরা ফসল ফলাতেন সেগুলোর বেশ কটিই এখন রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। রোহিঙ্গারা পাখি ধরার জন্য তাদের ফসলের খেতে বিষ দিয়েছিল। আর সেই বিষ খেয়ে তাদের ১০ থেকে ১২টি মুরগি মরে গেছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও ফল হয়নি। আজ গরু নিয়ে যাচ্ছে তো কাল নিচ্ছে ছাগল। গরু চরাতেও তারা নিরাপদ বোধ করছেন না। যে কারণে গবাদি পশু সব বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তেলিপাড়া গ্রামের এক গৃহস্থ পরিবারের আমিনা বেগম তার জমি দেখিয়ে বলেন, ওইখানে ওই জমিতে এক বছর হলো চাষ করতে পারছি না। সেখানে রোহিঙ্গারা বাস করছে তাই। এই এক বছরে দুবার ধান লাগাতে পারতাম। এই অভিজ্ঞতা উখিয়া টেকনাফের প্রায় সব বাসিন্দাদের। বেশ কটি মৌসুম পার হয়ে গেছে। বহু কৃষকের চাষাবাদ বন্ধ। গত মাসের শেষ সপ্তাহে টেকনাফ ও উখিয়ার শতাধিক বাসিন্দার সঙ্গে তাদের অভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা জানা গেছে। প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় বাসিন্দারা এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। এই রোহিঙ্গারা কবে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি-না তাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। তারা বলছেন, আমরা এখন নিজ ঘরেই পরবাসী হয়ে গেছি। সরেজমিনে জানা যায়, বনের গাছপালা, পাহাড় কেটে উজাড় করা হয়েছে। যে জমিগুলোতে স্থানীয়রা ফসল ফলাতেন সেগুলোর অধিকাংশই এখন রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। কোনো অনুমতি ছাড়াই রোহিঙ্গারা এখন সেখানে চাষাবাদ শুরু করেছে। সন্ধ্যায় টেকনাফ-উখিয়ায় আতঙ্ক নেমে আসে। কারণ পথে-ঘাটে, পাহাড়ে সবখানেই রোহিঙ্গা অপরাধীরা ওতপেতে আছে। যে কোনো সময় অস্ত্রের মুখে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয় পথচারীদের কাছ থেকে। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের উল্টোপাশেই রয়েছে বালুখালী কাশেমিয়া উচ্চবিদ্যালয়। স্কুলটিতে রোহিঙ্গা নিবন্ধন ক্যাম্প থাকায় গত এক বছর ধরে শিক্ষা কার্যক্রম একরকম বন্ধই ছিল। এখন সেটা চালু হলেও এলাকার যুবসমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন স্কুলটির একজন শিক্ষক। ‘গতবার এসএসসিতে আমাদের স্কুলের রেজাল্ট অনেক খারাপ হয়েছে। এবারও আমরা খুব একটা আশাবাদী না।’ তিনি জানান, ‘স্কুলে এখন শিক্ষার্থীরা কম আসে। ...বিশেষ করে যুবক শ্রেণি এখন ক্যাম্প এলাকায় ঘোরাঘুরি করে বেশি। অপরাধ আর অসামাজিক কার্যকলাপ বেড়েছে’। গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই শিশু অপহরণকারী সন্দেহে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে বেধড়ক পেটায় রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। উখিয়া এবং টেকনাফে স্থানীয়দের তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি। উখিয়া এবং টেকনাফে যেখানে স্থানীয় মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। সেখানে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা প্রায় ১২ লাখেরও বেশি ছাড়িয়েছে। ফলে বিভিন্ন ধরনের মানসিকতার এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে। মানবিক সহায়তা হিসেবে বিদেশ থেকে যে কোটি কোটি টাকা আসে তার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয় রোহিঙ্গা শিবিরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সামনে দিয়ে দেশি-বিদেশি এনজিও ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার শত শত গাড়ি রোহিঙ্গা শিবিরে যাতায়াত করে। মানবিক সহায়তার কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত দেশি কর্মীদের বড় অংশই উখিয়া ও টেকনাফের বাইরের। এমনকি রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিওগুলো স্থানীয়দের বাদ দিয়ে রোহিঙ্গাদের কাজ দিচ্ছে। তাই চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চনার জোরালো অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।  এইচ ডি মিলন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘উখিয়ার জামতলীর পনেরো নম্বর শিবিরে রোহিঙ্গাদের চাকরি থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল সব দেওয়া হচ্ছে। এনজিওগুলো আবার রোহিঙ্গাদের দিয়ে দিনমজুরের কাজও করাচ্ছে। আমার এলাকায় অসহায় দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ কী করবে?’ উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান এক ফেসবুক বার্তায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বলেছেন, তাদের সব যৌক্তিক দাবির সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন সব সময় একমত। এনজিওগুলোতে চাকরিসহ স্থানীয় জনসাধারণকে সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ সচেষ্ট রয়েছে। জানতে চাইলে উখিয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি সারোয়ার আলম শাহীন বলেন, উখিয়া এবং টেকনাফের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে সবখানে। এখানকার ডেমগ্রাফিক সিচুয়েশন পরিবর্তন হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এভাবে দীর্ঘদিন সবকিছু চালিয়ে নেওয়া কঠিন ব্যাপার হবে বলে তিনি মনে করেন।

স্থানীয় মানুষকে অবর্ণনীয় দুঃখ সহ্য করতে হচ্ছে -ইউএনএইচসিআর প্রধান : কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশ সফররত ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় মানুষকে অবর্ণনীয় দুঃখ সহ্য করতে হচ্ছে। তিনি গতকাল বিকালে কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালামের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশকে সমর্থন প্রদান অব্যাহত থাকবে। মিয়ানমার থেকে ২ বছর আগে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থা পর্যালোচনা করতেই আমরা আবার বাংলাদেশে এসেছি।

মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার বিষয়টি রোহিঙ্গাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে উল্লেখ করে ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, জাতিসংঘ মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।

সর্বশেষ খবর