শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নতুন কোনো খেলাপি ঋণ হবে না, শৃঙ্খলা ফিরবে আর্থিক খাতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন কোনো খেলাপি ঋণ হবে না, শৃঙ্খলা ফিরবে আর্থিক খাতে

আ হ ম মুস্তফা কামাল

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ব্যাংক খাতে নতুন করে আর কোনো খেলাপি ঋণ বাড়বে না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংস্কৃতিও বন্ধ করা হবে। সেই সঙ্গে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের নৈরাজ্য এবং পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার প্রতিফলন আগামী বাজেটে দেখা যাবে। গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক, এনজিও প্রতিনিধি ও ইআরএফের সঙ্গে এক প্রাক্্-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি ব্যাংকের উচ্চ সুদ হারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত বেশি পরিমাণে সুদ দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই এত উচ্চ হারে সুদ নেওয়া হয় না। আমরা এটাকে একটা সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।’ একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, সংকটাপন্ন সংবাদপত্র শিল্পের জন্য তিনি ইতিবাচক কিছু না কিছু করবেন। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের খেলোয়াড়দের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাদের ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এই মুহূর্তে শেয়ারবাজারে মানুষের আস্থাহীনতা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এখানে ৫০ হাজার নয়, ৫ লাখ কোটি টাকা দিলেও তা শেষ হয়ে যাবে। বাজেটের আগে মার্কেটের সূচক বাড়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো কমছে। শেয়ারবাজারে দুটি গোষ্ঠী সব সময় সক্রিয় থাকে। এর একটি হলো সিংহ, আর অপরটি ছাগলের বাচ্চা। এ ক্ষেত্রে ছাগলের বাচ্চারা সব সময় আতঙ্কে থাকে। আর সিংহরা সব সময় গেইন করতে থাকে। এ জন্য জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে এক দিনের জন্য বা স্বল্প সময়ের জন্য নয়, দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করুন। তাহলে প্রত্যেকেই লাভবান হবেন।’  অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার। আলোচনায় অংশ নেন অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শাহ হোসাইন ইমাম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন নিউজটুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, ইআরএফ সভাপতি সাইফ ইসলাম দিলাল প্রমুখ। সূচনা বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আসছে বাজেটে করের বোঝা না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো হবে। দেশের মোট সংখ্যার কমপক্ষে চার কোটি মানুষ কর দেওয়ার কথা কিন্তু দিচ্ছে মাত্র ১৮ থেকে ২০ লাখ। এ জন্য প্রত্যেককেই করের আওতায় আনা হবে। তবে এর জন্য যার আয় বেশি তিনি বেশি কর দেবেন। আর যার আয় কম তিনি কম কর দেবেন। এমন নিয়ম চালু করা হবে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ভালো ঋণগ্রহীতাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করা হচ্ছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশের মতো উচ্চ সুদ হার পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। এ জন্য আমরা একটা নতুন সিস্টেমের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছি। মানুষকে অনেক কষ্ট দেয় ব্যাংকিং সিস্টেম। এগুলো বন্ধ করা হবে। আমরা কারও ওপর বোঝা চাপাতে চাই না।’ প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ভ্যাট আইন ১৯৯১-এর শিডিউল-২ অনুযায়ী সংবাদপত্র শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে নিউজপ্রিন্ট আমদানি ভ্যাটমুক্ত পণ্যের তালিকাভুক্ত। অথচ নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া নিউজপ্রিন্টের ওপর আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য খরচসহ মোট ল্যান্ডেড কস্ট দিতে হয় ৩১ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এতে পত্রিকা প্রকাশ করা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। করপোরেট ট্যাক্সও কমানোর প্রস্তাব করেন মতিউর রহমান। সাংবাদিকদের বাড়িভাড়া হিসেবে পরিশোধিত অর্থও শতভাগ করমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মূল বেতনের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়ায় করমুক্ত রয়েছে। বর্তমান বেতনকাঠামোতে সাংবাদিকদের বাড়িভাড়া দেওয়া হয় ৭০ শতাংশ। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ বাড়িভাড়ায় কর প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বিদেশি টিভি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এ ছাড়া কেব্্ল অপারেটররা শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করলেও টিভি মালিকদের কোনো পয়সা দেন না। এ জন্য কেব্্ল সিস্টেমকে ডিজিটালাইজ করার দাবি জানান তিনি। এতে একদিকে টিভি মালিকরা যেমন পয়সা পাবেন, তেমন সরকারও রাজস্ব পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সঞ্চয়পত্র নিয়ে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন রকম পেরেশানিতে আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে বাড়ি কেনা হচ্ছে। এ টাকাটা ফেরত আনা দরকার। এসব বিষয়ে বাজেটে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানান তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘সংবাদপত্র একটা সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও আমরা কোনো সুবিধা পাই না। পোশাক শিল্প একটি মুনাফা অর্জনকারী শিল্প হওয়া সত্ত্বেও করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১২ শতাংশ। অথচ সংবাদপত্র শিল্প করপোরেট ট্যাক্স দিয়ে আসছে ৩৫ শতাংশ। এসব বাধা দূর করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর্থিক খাতে নজিরবিজীন বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আর্থিক খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত। এ খাতে কোনো রকম দায়বদ্ধতা নেই। এ খাতে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান চলমান থাকলে আপনার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। মনে হয় যেন ব্যাংকের কাজ হচ্ছে কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়ার জন্য, কিছু মানুষ ব্যাংকের টাকা লুট করার জন্য। এরপর যাকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার পরে তা অবলোপন করে মাফ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা। সাফল্যটাকে খেয়ে ফেলবে এসব প্রশ্ন। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোই হবে এ মুহূর্তে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আপনার জন্য বড় সাফল্য।’ নঈম নিজাম বলেন, ‘একজন প্রবাসী ভাই দীর্ঘদিন পর দেশে আসেন। এসেই বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হন। একজন মানুষ জায়গাজমি বিক্রি করে বিদেশ যান। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। আর দেশে ফেরার সময় তারা অযথা হয়রানির শিকার হন। এটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কারা বিদেশ থেকে কালোবাজারি করে তাদের দেখলেই অনুমান করা যায়। যারা স্মাগলিং করে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেনে। তাদের ধরুন। নিরীহ মানুষকে হয়রানি বন্ধ করতে হবে।’ শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজারের জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এখানে দিন দিন সংকট বাড়ছে। এই সংকট মোকাবিলা করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া কর প্রদানের ক্ষেত্রে যেসব আতঙ্ক ও হয়রানি রয়েছে, তা কীভাবে দূর করা যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বেশিসংখ্যক মানুষকে কীভাবে করের আওতায় আনা যায়, বাজেটে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বাড়িয়ে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলারও দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের জন্য যেসব জিনিসপত্র কেনা হয়, সেগুলোর আদৌ প্রয়োজন আছে কি না- সে বিষয়ে দায়বদ্ধতা তৈরি করতে হবে। এ খাতে এক ধরনের হরিলুট পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে করেন তিনি। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ঢাকার পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। শহরটা বাড়ি-গাড়িতে থই থই করছে। প্রতিনিয়তই গাড়ি বাড়ছে কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কমছে না। তাই ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে।’ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে শিক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। দিন দিন বিজ্ঞান শিক্ষার হার কমছে। দেশের উন্নয়ন করতে হলে বিজ্ঞান পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে হবে।’ সবার বক্তব্য শোনার পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ব্যাংকিং ব্যবস্থা খুব ভালো আছে এটা বলব না। তবে খুব খারাপও নেই। এ খাতের উন্নয়নে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি হচ্ছে। অনেকেই খেলাপি ঋণের বিপরীতে কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না। মামলা করতে পারছে না। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেবে আসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। ব্যাংক ঋণে সুদের হার বেশি। এত বেশি সুদ দিয়ে কখনোই ব্যবসা করা যাবে না। সুদের হার অনেক কমিয়ে নিয়ে আসা হবে। এ ছাড়া বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা থাকবে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। অসততা আমাকে স্পর্শ করেনি, করবেও না। আমি অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। সাধারণ মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমি অনুরোধ করব, এই দেশটা আমাদের। দেশের যাতে ক্ষতি না হয়, দেশের মানুষের চলার পথে যাতে প্রতিবন্ধকতা না হয় সে জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। সবাই সবার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর