শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফণা তুলে আসছে ফণী

ভারতে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, প্রস্তুতি বাংলাদেশেও

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফণা তুলে আসছে ফণী

উত্তাল সাগর। চলছে সতর্কতামূলক মাইকিং -বাংলাদেশ প্রতিদিন

মহাবিপদ সংকেতের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে ধেয়ে আসছে ফণী। উপকূলীয় এলাকাগুলোয় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সারা দেশে নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। উপকূলীয় ১৯ জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী আজ সকাল থেকেই ফণীর অগ্রভাগের প্রভাবে খুলনা ও বরিশাল উপকূলে ঝড়ো হাওয়াসহ বর্ষণ শুরু হতে পারে। সন্ধ্যা নাগাদ প্রবল শক্তি নিয়ে এটি উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এ সময় চার-পাঁচ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে উপকূলের নিম্নাঞ্চল। এ সময়ের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকা সব মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ফায়ার সার্ভিস, নৌ, সেনা, বিমানবাহিনীসহ ১৯ উপকূলীয় জেলার ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে চার হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্র। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. সামছুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সারা রাত ‘অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল’ সময়। ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বাতাসের গতি নিয়ে ফণী বাংলাদেশ অতিক্রম করবে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়টি ক্রমশ আরও শক্তি সঞ্চয় করছে। এর বর্তমান ব্যাস ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ভারতের উপকূল হয়ে এলেও এর একপাশ সাগরেই থাকবে, ফলে এটি আবার সাগর থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। গতকাল সন্ধ্যানাগাদ ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিমির মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ কিমি, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৮০ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই গতিবেগ ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এদিকে ভারতের স্বনাম খ্যাত প্রিন্ট মিডিয়া দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি ভারতে আছড়ে পড়ার সময় ঘণ্টায় প্রায় ২০৫ কিলোমিটার গতি থাকবে। ১৯৭৬ সালের (গত ৪৩ বছরে) পর এখন পর্যন্ত (এপ্রিলে) বঙ্গোপসাগরে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার কোনোটি কখনই এত শক্তিশালী আকার ধারণ করেনি। আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় জানান, ঘূর্ণিঝড় ফণী বর্তমানে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯১০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৮৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৬৬ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে। এটি উড়িষ্যা উপকূলে আঘাত হেনে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে সন্ধ্যার দিকে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চল অতিক্রম করতে পারে। এদিকে বিকালে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যায় আঘাত হানে। ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার বেগের ঝড়ো হাওয়ায় ওই এলাকায় উপড়ে যায় বড় বড় গাছ।

সতর্কতা জারি : গতকাল সন্ধ্যায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে (গতকাল সন্ধ্যায়) ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদফতর। আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলা এবং সংলগ্ন দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। আর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং নিকটবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে চলাচলরত সব নৌযানকে নিরাপদে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্লাবিত হতে পারে দেশের যেসব এলাকা : বৃহস্পতিবার সকালে আবহাওয়া অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় এবং অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪-৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলাগুলো এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৯০-১১০ কিমি বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।

নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা : ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে সারা দেশে সব নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এ ছাড়া প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার জাহাজ। সেই সঙ্গে সারা দেশে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। ফণীর সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ১৯ জেলায় সাড়ে তিন হাজারের ওপরে আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলাগুলোতে ৫ লাখ করে টাকা, ২০০ টন চাল এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে।

এ ছাড়া প্রস্তুত রাখা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস, নৌ, সেনা, বিমানবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের। উপকূলীয় এলাকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের দল ও মেডিকেল টিম। ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা দেশের উপকূলীয় ১৯ জেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারি সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। উপকূলীয় সব উপজেলায় দুর্যোগের ক্ষতি মোকাবিলায় দুর্যোগের ক্ষতি কমিয়ে আনতে প্রস্তুতি সভা হচ্ছে। এদিকে সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য গতকাল বিকাল থেকেই উপকূলীয় এলাকাগুলোয় মাইকিং শুরু করে স্বেচ্ছাসেবকরা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে। সচিবালয়ের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নম্বর ৮০১/ক এবং টেলিফোন নম্বর ০২-৯৫৪৬০৭২।

বন্দরে পণ্য ওঠানামা বন্ধ : ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নিজস্ব সংকেত ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করা হয়েছে। এ সতর্কতার পদক্ষেপ হিসেবে বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য উঠানো-নামানোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া পণ্যবাহী জাহাজগুলো জেটি থেকে সমুদ্রে পাঠানো হয়।

সংসদে সতর্কতা : সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে সংসদ ভবনের মতো বিশাল স্থাপনার কোনো কক্ষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা কোথাও আগুন না লাগে এ জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রত্যেক কক্ষের বৈদ্যুতিক বাতি, এসির সুইচ যাতে বন্ধ থাকে সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়। সংসদ ভবনের প্রতিটি শাখা/অধিশাখায় রাখা সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে এ ঘোষণা আসে।

আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইট বন্ধ : এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের খবর জানতে গতকাল দুপুর থেকে কেউ আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারেনি। অধিদফতর থেকে জানানো হয়, একসঙ্গে অনেক মানুষ ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করায় এটি হ্যাং হয়ে গেছে। এ সময় অধিদফতরের ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল সন্ধ্যার পরও ওয়েবসাইটটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সর্বশেষ খবর