শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

হতাশ ঐক্যফ্রন্ট, ক্ষুব্ধ ২০ দল শরিকরাও

বিএনপির চার এমপির শপথ

মাহমুদ আজহার

ইউটার্ন নিয়ে বিএনপির চার এমপির শপথ গ্রহণকে ভালো চোখে দেখছে না দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারবিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী মোর্চা ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। কাউকে না জানিয়ে বিএনপির এ ধরনের সিদ্ধান্তে ঐক্যফ্রন্ট অনেকটাই ‘হতাশ’ ও ‘হতভম্ব’। এ নিয়ে সামনের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বিএনপির কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারে বলে জানা গেছে। বিএনপির ‘দ্বিমুখী’ আচরণে চরম ক্ষুব্ধ ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও। দলটির হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয় সম্পর্কে পুরো অন্ধকারে ছিল তারা। নির্বাচনের পর ঝিমিয়ে পড়া ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও সামনের বৈঠকে এ বিষয়ে বিএনপির কাছে জানতে চাইবে। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া দলের কেউই এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। তা ছাড়া চার নির্বাচিত এমপিই শপথ নেওয়ার ব্যাপারে ছিলেন নাছোড়বান্দা। তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন জিয়া পরিবারের এক সদস্য। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ছিল যে এমপিরা মিলে বিএনপি ভেঙে ‘নতুন দল’ ঘোষণার দ্বারপ্রাপ্তে চলে যান। বিষয়টি অবগত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ কারণেই তাকে এমপিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। দলের ভাঙন ঠেকাতে অনেকটা বাধ্য হয়েই এমপিদের শপথে রাজি হন তারেক রহমান। অন্য একটি সূত্রমতে, দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ‘জামিন’ বা ‘প্যারোলে’ মুক্তি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে একটি ‘অলিখিত সমঝোতা’ হয়েছে। বিএনপির এমপিরা শপথ নেওয়ার পর বেগম জিয়ার মুক্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। খুব শিগগিরই বেগম জিয়া জামিনে মুক্তি পেতে পারেন বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। বিএনপির ইউটার্ন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। বিএনপির এ সিদ্ধান্তে ঐক্যফ্রন্টে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে সমঝোতা হলে তা খোলাখুলি বলুক, কী সমঝোতা হয়েছে? আমার মনে হয়, বিএনপি সমঝোতা করলে অনেক আগেই সমঝোতা করতে পারত। বেগম খালেদা জিয়া যদি সমঝোতা করতেন, তাহলে উনি প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। ’

সূত্রে জানা গেছে, ভোটের পর থেকেই হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি ঐক্যফ্রন্টে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর দুই একটি নামকাওয়াস্তে বৈঠক হলেও তাতে বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছেন শুধুমাত্র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা প্রভাবশালী নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে যোগ দেননি। এমনকি পরে দলের অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য করা হলেও তিনি একটি বৈঠকেও যাননি। এরপর গণফোরামের দুই নেতার শপথ এবং পর্যায়ক্রমে বিএনপির পাঁচ প্রতিনিধির শপথ গ্রহণে ঐক্যফ্রন্টে চরম অস্বস্তি বিরাজ করছে। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের দ্বৈত ভূমিকা ও বিএনপির ইউটার্নে বিরক্ত জাতীয় ফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলো।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও জোটের শীর্ষ নেতারা বলছেন, আমরা যে নির্বাচনকে অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করেছি, সেই পার্লামেন্টে বিএনপির বা গণফোরামের প্রতিনিধি যায় কীভাবে? এখানে আমাদের রাজনীতি থাকল কোথায়? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়াই যেখানে ভুল ছিল, সেখানে চতুর্মুখী চাপে জোট ও ফ্রন্টকে ভোটে যেতে হয়েছে। শুরুতেই কথা ছিল, বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোটে যাব সবাই। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আন্দোলন বাদ দিয়ে শুধু খালি হাতে নির্বাচনে গেছে। ঐক্যফ্রন্টের এক প্রভাবশালী নেতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন। এরপর ভোটের আগের দিন রাতেই যে চিত্র দেখা গেল, তাতে ফ্রন্ট বা জোটের ভরাডুবি নিশ্চিত হয়। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, এ সরকার ও সংসদকে বৈধতা দেওয়া হবে না। এ নিয়ে সভা-সমাবেশেও জোট ও ফ্রন্টের নেতারা নানা বক্তব্যও দিচ্ছিলেন। এখন জোট বা ফ্রন্টের রাজনীতি কোথায় থাকল?

এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ‘এখন অনেক কিছুই হয়ে গেছে। এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের মিটিংয়ে বসতে হবে। কোনো দল যদি বেরিয়ে যেতে চায়, তাহলে তো করার কিছু নেই। আমরা চাই, ঐক্যফ্রন্ট আরও শক্তিশালী হোক। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। শিগগিরই বৈঠক হবে আশা করছি।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত ছিল এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান। আমরা নতুনভাবে নির্বাচন চাই। তার মানে আমাদের দৃষ্টিতে এ সরকার ও সংসদ অবৈধ। এরপর ফ্রন্টকে না জানিয়ে কোনো দলের নির্বাচিত কয়েক নেতার শপথগ্রহণ আমাদের কাছে দুর্বোধ্য। অতএব কোনো রাজনৈতিক আঙ্গিক থেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটা যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় আলোচনা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করা যায় না। তবে এ সিদ্ধান্তের কারণ ও যৌক্তিকতা এখন পর্যন্ত আমরা বুঝতে অক্ষম। এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে।’

বিএনপির চার নেতার শপথ প্রসঙ্গে জোটের শরিক দল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের শপথের আগে ২০ দলের নেতারা, অন্তত আমি এ প্রসঙ্গে ঘূর্ণাক্ষরেও কিছু জানি না। গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পারলাম। বিএনপির অতি শীর্ষ নেতারাও জানতেন না। আমি বিক্ষুব্ধ নই, কারণ, কিছুদিন ধরে অনুভব করছি যে, ২০-দলীয় জোটকে প্রান্তিকরণ করে ফেলা হয়েছে।

২০-দলীয় জোটের শরিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির যে ১৮০ ডিগ্রি ইউটার্ন, এটা এলডিপি জানে না। আমার মনে হয়, ২০-দলীয় জোটেরও কেউ জানেন না। এতে আমরাও হতাশ।’

সর্বশেষ খবর