শনিবার, ৪ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

গুদামে বিপুল মজুদ তবু রোজার আগে বাজার অস্থির

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত মজুদের কারণে ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ দশা। তবু মূল্য বৃদ্ধির হল্কা যেন এই বৈশাখের তাপকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রোজার আগে এমন বাজার পরিস্থিতিতে চরম অসন্তোষ ক্রেতাদের মধ্যে।

সরেজমিন প্রকাশ, বিশ্ববাজারে দাম কমেছে রমজানের প্রাত্যহিক খাদ্যশস্য ছোলার। তাই দেশের বাজারে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আপাত আশঙ্কা নেই। তবে পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও রমজানকে কেন্দ্র করে অন্যান্য নিত্য খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছেই দেশের প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে খুচরা বাজারের সর্বত্র। বাজার মনিটরিংয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। তবু গরমের দোহাই দিয়ে পরিবহন ব্যয় ও অন্যান্য খরচের নামে মূল্য বৃদ্ধি জায়েজ করতে চান ব্যবসায়ীরা। সাধারণ ক্রেতারা আছেন চরম দুর্ভোগে। তারা চান পর্যাপ্ত বাজার মনিটরিং। দায়িত্বশীল কর্তারা বলছেন, এবার রমজান ঘিরে বাজার নিয়ন্ত্রণেই আছে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি ও কাজীর দেউড়ি, বহদ্দারহাট, বকসিরহাটের খুচরা দোকানিরা জানান, পবিত্র রমজান ঘিরে ছোলার দর ছাড়া প্রায় সবকিছুরই দাম বেড়েছে গেল এক সপ্তাহে অন্তত দুইবার। এসব বাজারের উদ্বিগ্ন ক্রেতারা জানান, পণ্যমূল্যের তালিকা প্রদর্শনের নিয়ম মানা হচ্ছে না অন্তত ৮০ শতাংশ দোকানেই। বাজার মনিটরিং টিম কিংবা অভিযানকারীরা এলেই প্রদর্শিত হচ্ছে তালিকা।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে আমদানিকারক, গুদাম-মালিক, পাইকারি ও খুচরা দোকানি সবাই স্বীকার করলেন, এবার পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তবু মূল্য বৃদ্ধিতে অসন্তুষ্টি জানালেন ক্রেতারা। ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতি টন ছোলার দর প্রায় ১৫০ ডলার করে কমে ৭৫০ ডলারের স্থানে ৬০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। ফলে এবার রোজায় আর নতুন করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা না হলে ছোলার দাম বাড়বে না। সিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম অবশ্য বলেছেন, শুধু ছোলা নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, তেল, ডালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমেছে। অভিন্ন মত ব্যক্ত করে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার রমজানের বাজার পরিস্থিতি খুব ভালো। তিনি জানান, সাধারণত বাজারে অস্ট্রেলিয়ার ছোলার সরবরাহ থাকে প্রচুর। এবার মিয়ানমার থেকেও পর্যাপ্ত ছোলার সরবরাহ আছে। তেলের পাইকারি দরও গত বছরের চেয়ে কম। চিনিও পাইকারিতে গত বছর যেখানে ছিল ১৯০০ থেকে ২০০০ টাকা, সেখানে বর্তমানে ১৭০০ থেকে ১৭৫০ টাকা। মসুর ডাল যেখানে গেল বছর পাইকারিতে কেজিপ্রতি ৫৫-৬০ টাকা ছিল, সেখানে এবার ৪৬-৪৭ টাকা। একইভাবে ছোলা ৭৫-৮০ টাকার বদলে ৬২-৭০ টাকায়, মটর ডাল ৩৮-৩৯ টাকার স্থলে ২৮-২৯ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে এবার। মসলার বাজার স্থিতিশীল বলে দাবি করা হলেও বাস্তব চিত্রের ভিন্নতা পাওয়া গেছে খুচরা বাজারে। খাতুনগঞ্জের আড়তদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি সোলায়মান বাদশা জানান, পর্যাপ্ত মজুদ আছে রমজানে প্রয়োজনীয় নিত্য খাদ্যপণ্যের। তবে ক্ষেত্রবিশেষে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। তা যুক্ত হচ্ছে পণ্যমূল্যে।

একাধিক আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতা জানান, বিশ্ববাজারে দাম কমায় ছোলার দর কিছুটা কমলেও খেজুর ও চিনির দর বাড়ছে। আমদানিনির্ভর খেজুরের বাজারদর নিয়ে যেন লুকোচুরি খেলা চলছে। স্বাভাবিক দরটি রবিবার ম্যাজিস্ট্রেসি অভিযানকালে যেন বদলে যায়। অন্যদিকে চট্টগ্রামের বাজারে ‘এস আলম’-এর হাতে চিনির একক নিয়ন্ত্রণ থাকায় এর ঊর্ধ্বমুখী মূল্যে কেউ যেন রা করার নেই! চিনির দর গত এক সপ্তাহে মণপ্রতি ৩০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খুচরা মূল্যে যা কেজিতে কোথাও কোথাও পাঁচ টাকা করেও বেড়েছে। খুচরা দোকানিরা জানান, তীব্র গরমে শরবত-ট্যাঙের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চিনির চাহিদাও বেড়েছে। তাই বেড়েছে মূল্য। কাজীর দেউড়ির সিডিএ মার্কেটের ব্যবসায়ী নাছির বলেন, পাইকারি বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। কাজীর দেউড়ি সিডিএ মার্কেটে গত এক সপ্তাহে পিয়াজের দাম কেজিপ্রতি তিন টাকা বেড়েছে। গরমের কারণে চিনির চাহিদা বেড়েছে জানিয়ে নাছির সওদাগর বলেন, কয়েকটি মসলার দাম বাড়লেও অপরিবর্তিত আছে বেশির ভাগ। এলাচের দাম গত এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা বেড়েছে। দারচিনির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও ভারতীয় জিরার দাম কিছুটা বেড়েছে। দারচিনি প্রতিকেজি গত এক মাসের ব্যবধানে ২০ টাকা এবং ভারতীয় জিরার দাম এক সপ্তাহে ১৫ টাকা বেড়েছে। মসুর ডাল সপ্তাহের ব্যবধানে ২০ টাকা ও খেসারির দামও মণে বেড়েছে প্রায় ৪৫০ টাকা। এদিকে ক্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জানান, অসাধু ব্যবসায়ীরা রোজার আগেই মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নিতে পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিক্রেতারা একে অন্যকে দোষারোপ করেও দর বৃদ্ধি করতে চান। এমন অবস্থা থেকে বাঁচতে স্বল্পকালীন অভিযান নয়, বাজারে ম্যাজিস্ট্রেসি টিমের দিনভর অবস্থান চান এই ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণ সংগঠক। সচেতন ক্রেতাদের দাবি অনুযায়ী পাইকারি ও খুচরা বাজারে দরের অস্বাভাবিক তারতম্য রোধে কঠোর মনিটরিং চান চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, বাজারে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সঠিক মনিটরিং করা গেলে এবার রমজানে মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা নেই। চট্টগ্রামের বাজার মনিটরিং টিমের নেতৃত্ব দানকারী অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মাসহুদুল কবির রবিবার তার প্রথম দিনের বাজার মনিটরিংয়ের অভিজ্ঞতায় জানান পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে অস্বাভাবিকতা। অর্থাৎ পাইকারি দরে ক্রয়ের পর খুচরা বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তা রোধ করতে পারলেই বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তিনি এ লক্ষ্যে লোকবল সংকট কাটিয়েও মনিটরিং অব্যাহত রাখতে প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথা জানান। এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এডিএম জানান, জেলা প্রশাসনে অতীতে নিয়মিত ২৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট থাকলেও বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ছয়জন। সিংহভাগ ম্যাজিস্ট্রেট প্রমোশন ও প্রশিক্ষণজনিত কারণে চট্টগ্রামে নেই। ছয়জন এসি ল্যান্ডকে সংযুক্ত করে ১২ সদস্যের টিম নিয়মিত শহরের সব কটি বাজার মনিটরিং করবে বলে জানান এই টিমপ্রধান।

সর্বশেষ খবর