রবিবার, ৫ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিস্তীর্ণ অঞ্চল লণ্ডভণ্ড

নিহত ১০, বিধ্বস্ত ৩ হাজার বাড়িঘর, খুলনা নোয়াখালী ভোলা লক্ষ্মীপুরে তাণ্ডব, অনেক এলাকা পানিতে তলিয়েছে, ফসলের ক্ষতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিস্তীর্ণ অঞ্চল লণ্ডভণ্ড

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিধ্বস্ত ঘর। খুলনায় বিধ্বস্তের পাশাপাশি বাড়িঘরে উঠেছে পানি। লক্ষ্মীপুরে উপড়ে গেছে বিপুলসংখ্যক গাছ -বাংলাদেশ প্রতিদিন ও এএফপি

শক্তি হারানো ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ বাংলাদেশে ১০ মৃত্যু ঘটিয়েছে। গাছপালা ভেঙে ও ঘরচাপায় নিহতদের মধ্যে নোয়াখালীর দুই শিশু, ভোলার এক নারী, লক্ষ্মীপুরের এক বৃদ্ধ, পটুয়াখালীর এক তরুণ, সিরাজগঞ্জের এক বৃদ্ধ ও এক শিশু, সাতক্ষীরার এক বৃদ্ধা ও বরগুনার দাদি-নাতি রয়েছেন। সারা দেশে বিভিন্নভাবে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ফণীর ঝড়ো হাওয়ায় দেশজুড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে কমপক্ষে তিন হাজার বাড়িঘর। বেড়িবাঁধ ভেঙে পানির নিচে ডুবেছে অর্ধশতাধিক গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান। আশ্রয় কেন্দ্রে রাত কাটানো প্রায় ১৫ লাখ মানুষ গতকাল দিনের বিভিন্ন সময় বাড়ি ফিরে গেছেন। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরানুসারে, লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে ‘ফনী’র ঝড়ে গাছচাপায় আনোয়ারা বেগম নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। নিহত আনোয়ারা রামগতির চরনেয়ামত এলাকার মো. সফিকের স্ত্রী। লক্ষ্মীপুরে বিভিন্ন উপজেলায় বিধ্বস্ত হয়েছে অর্ধশতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি। উপড়ে পড়েছে অসংখ্য গাছপালা। নোয়াখালীর  উপকূলীয় সুবর্ণচর, হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট কয়েক মিনিটির টর্নেডোর আঘাতে সুবর্ণচর উপজেলার চরআমানউল্যাহপুর ইউনিয়নে বসতঘরের নিচে চাপা পড়ে আবদুর রহমানের দুই বছর বয়সী ছেলে ইসমাইল হোসেনের মৃত্যু হয়েছে। গাছচাপায় নিহত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ফাহিমা আক্তার ঝুমুর। চরওয়াপদা ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখানে দুই শতাধিক কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। আহত হয়েছে অনন্ত ৩০ জন। আহতদের নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ও সুবর্ণচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। পটুয়াখালীর কুয়াকাটার মনসাতলীতে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আহত মোটরসাইকেল চালক হাবিবুর রহমান মুসল্লি (২৫) বরিশালে হাসপাতালে মারা যান। পৌরসভার ওরকা পল্লীর বাসিন্দা হারুন মুসল্লির পুত্র হাবিব। এ ছাড়াও ৮ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে দুই হাজার ৯২টি বসতঘর (আংশিক), ছয় হাজার একর জমির ফসল, তিন হাজার গাছপালা, ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ (আংশিক) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছেন ১১ জন। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় গাবুরা ইউনিয়নের গাইনবাড়ি আশ্রয় কেন্দ্রে আয়নামতি বিবি (৯২) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার মধ্য রাতে মারা যাওয়া মৃত শওকত শেখের স্ত্রী মতি বিবি অসুস্থ অবস্থায় আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

বরগুনার পাথরঘাটায় প্রচ  দমকা হাওয়ায় ঘর চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন একই পরিবারের দাদি ও নাতি। পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী গ্রামের দাদি নূরজাহান বেগম (৬০) ও নাতি জাহিদুল ইসলাম (৮) ভোররাতে ঝড়ে গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়লে মারা যান। এ সময় পাথরঘাটা উপকূলীয় এলাকায় শতাধিক আধাপাকা ঘর ও গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে বটগাছ ভেঙে পড়ে শিশুসহ দুজন নিহত হয়েছেন। উপজেলার ভানুডাঙ্গা বাজারে চরভানুডাঙ্গা সোহাগীপাড়া গ্রামের মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে ইসমাইল হোসেন (৬০) ও একই গ্রামের বকুলের মেয়ে বিথী আকতার (৭) মারা যান। এ ঘটনায় আরও অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। গাছ ভেঙে পড়ার কারণে প্রায় পাঁচটি দোকান ভেঙে চার লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভোলা সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামে ঘর চাপা পড়ে রানী বেগম (৪৫) নামের এক গৃহবধূ নিহত হয়েছেন। রানী বেগমের স্বামী সামসুল হক জানান, রাত ৪টার দিকে ঝড়ের আঘাতে তার বসতঘর ভেঙে পড়ে। ঘরে অবস্থানরত ৬ জনের মধ্যে রানী বেগম ঘরচাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ছাড়া ঝড়ের তা-বে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। দুই শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মেঘনা তেঁতুলিয়া নদীর জোয়ারের পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বেশ কিছু পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ি-ফসল, প্লাবিত লোকালয় : ভারি বৃষ্টিতে বরিশালের ১০ উপজেলায় ৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। ১ হাজার ঘরবাড়ি এবং বহু গালপালা উপড়ে পড়েছে। এ ছাড়া ৬৫ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক এবং ২০ মিটার পরিমাণ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাগর-নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে ৪টি গ্রাম এবং কলাপাড়ায় ৫টি গ্রাম বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া উজিরপুর উপজেলার সাতলা-বাঁগধা বেড়িবাঁধ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশপাশের গ্রাম। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বরিশালসহ সারা দেশে গতকাল তৃতীয় দিনের মতো সব ধরনের নৌচলাচল বন্ধ ছিল। খুলনার দাকোপ, কয়রা ও বটিয়াঘাটায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৯৯০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। বাকি ৩ হাজার ৬৫০টি ঘর আংশিক বিধস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিভিন্ন স্থানে গাছপালা উপড়ে পড়েছে। দাকোপ উপজেলায় রিংবাঁধ ভেঙে দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কয়রায় ঘাটাখালী, ঘোগড়া, হরিণখোলা এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব কাটতেই সাইক্লোন শেল্টার থেকে বাড়ি ফিরেছেন উপকূলের মানুষ। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের কারণে আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। ঘূর্ণিঝড়ে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার ৩২টি পোল্ডারের প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে। জরুরিভাবে খুলনার ১৫টি, সাতক্ষীরার ২২টি ও বাগেরহাটের ৮টি স্থানে বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। সিনথেটিক ব্যাগ, জিও ব্যাগ ও মাটির বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষা করা হয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বরগুনায় দুর্গত এলাকায় নৌবাহিনীর ৪টি জাহাজ জরুরি ত্রাণ বিতরণে কাজ করছে। চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় ফণীর তা বে শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে শতাধিক পরিবার রয়েছে। রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে মান্দের বাজার, মজিদকান্দি ও শিলারচর এলাকায় ঝড়ের তা ব চলে। উড়ে গেছে চিরারচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের চালা। মতলব উপজেলার চরাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে মসজিদসহ বেশ কিছু বসতঘর ল ভ  হয়েছে। ঘরে থাকা আসবাবপত্রেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ফণীর ছোবলে ফরিদপুরের দুটি ইউনিয়নে ২৮টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। উপড়ে গেছে কয়েক হাজার গাছ। সদরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর, ফতেপুর, ভবানীপুর ও চক ভবানীপুর গ্রামে শুক্রবার রাতে বয়ে যাওয়া ঝড়ে ১৮টি টিনের বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বেশির ভাগ বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেছে। এ ছাড়া ওই চারটি গ্রামে লিচু ও আমগাছসহ অন্তত শতাধিক গাছ উপড়ে গেছে।

‘ফণী’র প্রভাবে সমুদ্র উপকূলের বেড়িবাঁধ ভেঙে চট্টগ্রাম নগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বাতাসের অতি প্রবল বেগের কারণে বিভিন্ন স্থানে কাঁচা বাড়িঘর, গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। নগরীর ইপিজেড থানাধীন আকমল আলী রোড এলাকা, আনোয়ারার গহিরা, সরেঙ্গা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপসহ নিম্নাঞ্চলে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে পানি। ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমি। নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ ও নবনির্মিত বেড়িবাঁধের কিছু অংশ ভেঙে আনোয়ারার রায়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ গহিরা গ্রাম ও সরেঙ্গা গ্রাম লবণ পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ও মাছের ঘেরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে ঝড়ো বাতাসে বরেন্দ্র অঞ্চলের উঠতি বোরো ধানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলার গোদাগাড়ী, তানোর, পবা ও মোহনপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাকা বোরো ধান নুয়ে পড়েছে।

বাধাগ্রস্ত যান চলাচল : ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে শুক্রবার থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় উভয় ঘাট এলাকায় আটকে পড়েছে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক যানবাহন। এসব যানবাহনের শ্রমিক ও যাত্রীরা  চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা সংলগ্ন ভোগড়া বাইপাস ও সাইনবোর্ড এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ধীরগতিতে চলতে বাধ্য হয়। জেলার বিভিন্ন নিচু স্থানে ও সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন নিচু রাস্তায় পানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

উপড়ে গেছে বিদ্যুতের খুঁটি : ঝড়ে গাজীপুরে পল্লী বিদ্যুতের ১৫টি খুঁটি সড়কে উপড়ে পড়েছে। শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জেলা পুলিশ লাইনের সামনে বৈদ্যুতিক ব্রি সাব-স্টেশনের কাছে ঢাকা-গাজীপুর সড়কে এসব খুঁটি উপড়ে যায়। এতে ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গাছ ভেঙে বৈদ্যুতিক তারের ওপর পড়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম : আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, ঘূর্ণিঝড় ফণী পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত ও আহত রোহিঙ্গা সদস্যদের চিকিৎসা দিয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গতকাল বিকাল থেকে সেনা সদস্যরা ঝড়ে বিধ্বস্ত রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি নির্মাণ, ত্রাণের প্যাকেট প্রদানসহ বিভিন্ন সহায়তায় অংশ নেন।

সর্বশেষ খবর