শিরোনাম
সোমবার, ৬ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

শাহজালালে ঘাটে ঘাটে হয়রানি

কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লাভ নেই

সাঈদুর রহমান রিমন

শাহজালালে ঘাটে ঘাটে হয়রানি

শাহজালাল বিমানবন্দরের ঘাটে ঘাটে যাত্রী হয়রানি আর ভোগান্তির শেষ নেই। আন্তর্জাতিক এ বিমানবন্দরের ভিতরে-বাইরে একই চিত্র। শাহজালালের অভ্যন্তরে অন্তত ১০টি ধাপে যাত্রীদের কাছ থেকে চাহিদামাফিক টাকা হাতানোর ধান্দায় নানারকম হয়রানি চালানো হয়। বিমানবন্দরের বাইরেও নানা প্রক্রিয়ায় চলে হয়রানি-ভোগান্তি। যাত্রীসেবায় নিয়োজিত কাস্টমস, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর অর্থাৎ পুলিশ ও বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের একটা বড় অংশই নিয়মিত যাত্রী হয়রানি করছে। এর মাঝে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস নিয়ে মানুষ বেশি অতিষ্ঠ। বিদেশফেরত যাত্রীরা ভিতরে-বাইরে দুই পর্বে ১২-১৩টি ধাপে হয়রানির শিকার হন। কাস্টমস হলরুম থেকে বের হওয়ার পর ট্যাক্সিচালক, দালাল, ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া গোয়েন্দা ও ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের খপ্পরে পড়েও তাদের নাস্তানাবুদ হতে হয়। যাত্রীরা বিদেশ গমনের সময় বহির্গমন লাউঞ্জের প্রবেশমুখে কর্তব্যরত একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর খপ্পরে পড়েন। সেখানে টার্গেটকৃত যাত্রীদের পাসপোর্ট, টিকিট ইত্যাদি চেক করার সময় জানানো হয়, তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে। কাজেই তাকে দেশ ছেড়ে যেতে দেওয়া সম্ভব নয়। বিমানে ওঠার চূড়ান্ত মুহূর্তে এমন অভিযোগের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। দিশাহারা যাত্রীরা কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন। কিন্তু তাতে কান দেন না কেউই। সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশের দায়িত্ব¡ বহির্গমন, পার্কিং লট, ক্যানোপি, কনকর্স হল, আগমনী কনভেয়ার বেল্ট, টারমাক, রানওয়ে, ড্রাইওয়ে ও অ্যাপ্রোন এলাকায় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকা। তবে তারা অধিকাংশ সময়ই ব্যস্ত থাকে আগমনী আর কার পার্কিং এলাকায় যাত্রীদের মালামাল তল্লাশির কাজে। বিদেশ থেকে আসা অনেক যাত্রী বিমানবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গাড়িতে ওঠার পরই এই আর্মড পুলিশের তল্লাশির মুখোমুখি হন। নানা প্রশ্নে বিব্রত করা হয় যাত্রীদের। টানাহিঁচড়া করে আবার বিমানবন্দরের ভিতরে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এপিবিএন পুলিশ ও সিভিল টিম সদস্যরা শাহজালালে বহির্গমন যাত্রীদের ভিসা, পাসপোর্ট, টিকিট চেকিংয়ের নামে এসব হয়রানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ দায়িত্ব ইমিগ্রেশন পুলিশের হলেও তাদের থোরাই কেয়ার করছে এপিবিএন পুলিশ। বরং পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট চেকিংয়ের নামে এয়ারলাইন্স কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের ডেকে নিয়েও হয়রানি চালায় তারা। যাত্রীদের নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধ ফায়দা চায়, না দিতে পারলে যাত্রীদের ফ্লাইট অফলোডের ধকলে ফেলে দেওয়া হয়। এতে বাপ-দাদার ভিটেমাটি বিক্রি করে নানা কাঠখর পুড়িয়ে কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশগামী অনেক যাত্রীর ফ্লাইট অফলোডের ঘটনায় তাদের ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। এয়ারলাইনস থেকে তারা টিকিটের টাকাও রিটার্ন পায় না।

হয়রানি ধাপে ধাপে : বিমানবন্দরে প্রবেশপথের মোড় থেকেই শুরু হয় যাত্রী হয়রানি। এরপর কনকর্স হল, মূল ভবন, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস পোস্টসহ ঘাটে ঘাটে চলে বিরামহীন হয়রানি। ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলছেন, আগে দীর্ঘ জার্নি শেষে শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছে লাগেজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন এর সঙ্গে আরও নতুন উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ব্যাগেজ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, আবার তা পাওয়া গেলেও এমনভাবে ছুড়ে ফেলা হয় যাতে ব্যাগেজের মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। কখনো ব্যাগ ছিঁড়ে মালামাল পড়ে গেলে শুরু হয় লুটপাট। এদিকে বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানবন্দরের দোতলার প্রবেশপথে দীর্ঘসময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরাপত্তা তল্লাশির নামে যাত্রীদের এ ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে জানা গেছে। এমন অসংখ্য খাতে ঘাটে ঘাটে চলে যাত্রী হয়রানির কসরত।

বিমানবন্দরে দায়িত্বরত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিভাগীয় বৈঠকেও যাত্রী হয়রানি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। হয়রানি বন্ধে নেওয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও ‘বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধের ব্যাপারে’ কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, হয়রানি থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাচ্ছেন না যাত্রীরা। উল্টো দিন দিন হয়রানির মাত্রা বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছেন প্রবাসীরা। অথচ দেশে ফিরে তারাই বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত শুক্রবার বিমানবন্দরের দোতলায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া যায়। তারা বলছেন, শুধু লাগেজ পেতে এবং প্রবেশপথেই নয়, ইমিগ্রেশনেও যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিদেশে কর্মরত বৈধ শ্রমিকরাও চরম হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। সেখানে যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অজুহাতে টাকা আদায় করে নেওয়াই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এদিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ডেস্ক কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা কম, কাজে গতি নেই বললেই চলে। বরং পদে পদে সময়ক্ষেপণ আর হয়রানি-ভোগান্তি সৃষ্টিতে তাদের জুরি মেলা ভার। গত কয়েকদিন সরেজমিনে দেখা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাত্রীদের অপেক্ষার পালা যেন শেষ হতেই চায় না। কয়েকটি কাউন্টার ফাঁকা, সেখানে কোনো ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা নেই। যে কয়টিতে কর্মকর্তারা আছেন, তারাও ততটা দক্ষ নন। আবার কেউ কেউ কাউন্টার ছেড়ে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সে সব কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন জমে ওঠে। যে সব ডেস্কে কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছিলেন সেখানেও হয়রানির নানা ফন্দিফিকির লক্ষ্য করা গেছে। ২ এপ্রিল সন্ধ্যায় ইমিগ্রেশনে যাত্রী হয়রানির কবলে পড়ে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন একাধিক যাত্রী। কিন্তু তারপরও কোনো লাভ হয়নি। গত শুক্রবার দুবাইগামী যাত্রী মঞ্জুরুল আলম অভিন্ন অভিযোগ করে বলেন, ইমিগ্রেশন শেষ করতে তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সময়ক্ষেপণের হয়রানিতে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা জানান, পৃথিবীর সব দেশের বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশেন সম্পন্ন করতে লাগে ২/৩ মিনিট, সেখানে শাহজালালে ১৫/২০ মিনিটেও শেষ হয় না ইমিগ্রেশন। প্রযুক্তি কাজে খুবই ঢিলে প্রকৃতির, কাউন্টার কর্মকর্তারা অক্ষর খুঁজে খুঁজে কী বোর্ডের বাটন চাপেন। এ ব্যাপারে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্র ২২টি কাউন্টারেই যাত্রীসেবার সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। সেখানে নতুন কাউন্টার বসানোরও জায়গা নেই। পিকআওয়ারে যখন ৫-৬টি বিমান স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অবতরণ করে তখন যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। শুধু ইমিগ্রেশন নয়, শাহজালালের ঘাটে ঘাটেই যাত্রীদের নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। এদিকে কাস্টম হয়রানি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। অনেকে প্রশ্ন করছেন, অকারণে হয়রানি থেকে বিশিষ্ট নাগরিকদেরও রেহাই নেই।

সর্বশেষ খবর