সোমবার, ৬ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইতিহাসের নায়ক তোফায়েল শতায়ু হোন

পীর হাবিবুর রহমান

ইতিহাসের নায়ক তোফায়েল শতায়ু হোন

তোফায়েল ভাই আপনি শতায়ু হন। আপনি ইতিহাসের নায়ক। এদেশের রাজনীতিতে মানুষের কল্যাণে দেশ সেবায় আপনার অনন্য সাধারণ ভূমিকা অব্যাহত রাখুন। স্কয়ার হাসপাতালে ১০২৪ নম্বর কেবিনে আপনাকে দেখে এলাম। আপনি শিশুর মতো ঘুমাচ্ছিলেন। স্কয়ার হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ও সমন্বয়কারী বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুজ্জামান আপনার জামাতা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আপনার সন্তানতুল্য এই ভদ্র-বিনয়ী চিকিৎসকের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। তার সঙ্গে আলাপকালে জেনেছি চেস্ট পেইন ও কাঁপুনি দেওয়া জ্বর নিয়ে আপনি ভর্তি হলেও আপনার হার্টে কোনো সমস্যা নেই। হার্টবিট পালস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রক্তে সংক্রমণ ঘটায় সেটি চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি এন্টিবায়োটিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আরও কয়েক দিন আপনাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। তারপর ছেড়ে দিলে আপনি আপনার মতো গতিময়তা নিয়ে সংসদ ও রাজনীতিতে এবং মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবেন। বয়স আপনার কাছে নত হয়েছে। আপনি প্রখর স্মৃতিশক্তি, মেধা ও প্রচন্ড প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন কর্মউদ্যোগী মানুষ। বসে থাকা, শুয়ে থাকা আপনাকে মানায় না। ঘুম থেকে না জাগিয়ে যখন কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছিলাম তখন প্রবেশ করছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ মতিয়া চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ নেতা সুজিত রায় নন্দীসহ অনেকে। চিকিৎসকরা দর্শনার্থী বারণ করেছেন। কিন্তু একজন দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকবেন আর তার অগণিত ভক্ত-সহকর্মীরা দেখতে যাবেন না তা কি হয়? তাই চিকিৎসকদের বারণ সত্ত্বেও অনেকে ছুটে যাচ্ছেন।

তোফায়েল আহমেদের রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে সেই যে পাকিস্তানের লৌহমানব খ্যাত সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিলেন তারপর তার রাজনৈতিক জীবন সংগ্রামমুখর চ্যালেঞ্জের নানা আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে হেঁটে আজকের জায়গায় এসেছেন। ছাত্রলীগের সভাপতিই ছিলেন না। ডাকসুর ভিপি হয়ে ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলে এই দেশের রাজনীতির ইতিহাসে গৌরবের ’৬৯ জন্ম দিয়েছিলেন। ১১ দফাকে এক দফায় পরিণত করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে রক্তমাখা আসাদের শার্ট নিয়ে, শহীদ মতিউরের রক্তে শপথ নিয়ে ছাত্র গণআন্দোলনে বাঙালি জাতিকে গণজোয়ারে টেনে এনে তুমুল ঝাঁকুনি দিয়ে আইয়ুব খানের পতনই ঘটাননি, ফাঁসির মঞ্চ থেকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো লাখো জনতার সমাবেশে মহান নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তোফায়েল আহমেদ মানেই ইতিহাসের ’৬৯-এর রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পথে ’৭০-এর ব্যালট রায় নিয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করেছিল। মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তার গভীর স্নেহমমতাই পাননি, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর খুনি চক্র তাকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিন বছর কারাবরণ করেছেন। সামরিক শাসনবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক শাসন আমলের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়েছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া এমন কোনো শাসনামল নেই যেখানে বঙ্গবন্ধুর তোফায়েলকে কারাবরণ করতে হয়নি। তিনি এদেশের রাজনীতির এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ইতিহাসে তাই তোফায়েলরা বার বার জন্ম নেন না। বার বার ইতিহাস সৃষ্টিও করেন না। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হিসেবে জীবনের পরতে পরতে বহু নির্যাতন ও বেদনা সইতে হলেও কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। প্রখর মেধাবী ব্যাপক পড়াশোনা জানা উদার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তোফায়েল আহমেদ নানা মত-পথ সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখেন। তার বনানীর বাসভবন যেন ’৬৯-এর ছবির মিউজিয়াম। মহাকালের সাক্ষী হয়ে একেকটি ছবি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। বাড়ির লাইব্রেরি বই আর বইয়ে সমৃদ্ধ। তার মেহমানদের গাড়ি পর্যন্ত তুলে দিয়ে সম্মান দেখানো তার সংস্কৃতি। ভোলাকে স্বপ্নের মতো উন্নয়নে সাজিয়েছেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ডিজিটাল জাদুঘর নির্মাণ করেছেন। মাতৃভক্ত তোফায়েল মায়ের নামে বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ ও অনেক কিছুই প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিয়মিত লেখালেখিও করছেন। কয়েক দশকের উত্থান-পতন, ভাঙাগড়া রাজনীতির মহাকালের সক্রিয় সরব সাক্ষী তোফায়েল আহমেদ অনেক অজানা ঘটনা নিয়ে বইও লিখছেন। গণমাধ্যমবান্ধব তোফায়েল শিশুদের যেমন ভালোবাসেন, তেমনি সমাজে যে কারও বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ান। বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবে ব্যবসায়ীবান্ধব এই রাজনীতিবিদ সাফল্য কুড়িয়েছেন। তার মতো বর্ণাঢ্য এক আদর্শে অবিচল সংগ্রামী ইতিহাসের খ্যাতি অর্জন করা রাজনীতিবিদ হিসেবে রাজনীতিতে এখন তিনিই একমাত্র জীবিত। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্য অনেকবার হলেও নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী পরিচয়েই গর্ববোধ করেন। এই দেশ ও মানুষ, এই সংসদ ও রাজনীতিকে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বির্নিমাণে এখনো তার অনেক কিছু দেওয়ার আছে। আল্লাহ মেহেরবান। আমরা আশাবাদী শিগগিরই তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রাণবন্ত হাসি নিয়ে প্রখর মেধার স্বাক্ষর রেখে আবারও চেনা পথ ধরে হাঁটবেন।

সর্বশেষ খবর