রাজধানীর কুর্মিটোলায় জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাসের রেষারেষিতে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। গত ২৯ জুলাই এ দুর্ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সড়কে বিশৃঙ্খলার ভয়াবহতাকে। এরপর শিক্ষার্থী আন্দোলন, নানামুখী উদ্যোগের ভিত্তিতে সড়ক পরিবহন আইনের চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদিত হলেও মেলেনি আশু সমাধান। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সমন্বয়হীন বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে সড়কে নৈরাজ্য থামছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে বিশৃঙ্খলার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ হচ্ছে- যানবাহন চালকদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, নির্ধারিত বেতন-ভাতা ছাড়াই চুক্তিতে গাড়ি চালানো, যাত্রী ও পথচারীদের ট্রাফিক আইনের প্রতি উদাসীনতা, একই সড়কে ধীর ও দ্রুতগতির যানবাহন চলা, সড়কের বেশির ভাগ অংশ অবৈধ দখল ও পার্কিংয়ে অবরুদ্ধ রাখা ইত্যাদি। রাজধানীর সড়কসংলগ্ন বেশির ভাগ বিপণিবিতান, শপিং মল ও বাণিজ্যিক ভবনের গাড়ি পার্কিং করা থাকে মূল সড়ক দখলে রেখে। অথচ প্রতিটি ভবনেই নিজেদের গাড়ি রাখার জন্য পর্যাপ্ত পার্কিংসুবিধা থাকার কথা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে নৈরাজ্য রোধ করতে হলে সিটি করপোরেশন, রাজউক, ট্রাফিক বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
যাত্রী তোলার টার্গেটে চালকরা : গত বছরের এপ্রিলে দুই বাসের রেষারেষিতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের হাত হারানোর ঘটনায় বাসচালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। কিন্তু বছর পার হলেও অভিন্ন রয়েছে রাজধানীর গণপরিবহনের চিত্র। বেপরোয়া চলাচলে নিয়মিত হতাহতের ঘটনা ঘটলেও বিকার নেই বাসচালকদের। এর জন্য মালিকের বেঁধে দেওয়া জমার টাকা ওঠানোর তাগাদাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন অনেকে। অনাবিল পরিবহনের চালক শরিফ হোসেন জানান, বাসের জমার টাকা মালিকরা নির্ধারণ করে দেন। আবার কিছু পরিবহন তাদের আয় হিসাব করে ওয়ে বিলে মোট যাত্রী পরিবহনের ওপর। সেখানেও যাত্রী বেশি তোলার জন্য মালিকপক্ষের চাপ থাকে। প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের ধাক্কাধাক্কি, সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা। এ কারণে বেশির ভাগ বাসের গায়ের রং চটে গেছে। খুলে গেছে বাম্পার, হেডলাইট। রেষারেষিতে ভাঙছে অধিকাংশ বাসের ভিউ মিরর।
বেতন নেই চালক-হেলপারদের : রাজধানীর হাজার হাজার গণপরিবহন চালকের নেই কোনো নির্ধারিত বেতন কাঠামো। গাড়ির ট্রিপ অনুযায়ী কিংবা ওয়ে বিল বাদ দিয়ে মজুরি দেওয়া হয় পরিবহনশ্রমিকদের। পরিবহন খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলো জানায়, দেশের সরকারি যানবাহন ও ব্যক্তিগত গাড়ির কিছু চালক বাদে অধিকাংশ বাণিজ্যিক যানবাহন চালকের নির্ধারিত মাসিক কোনো বেতন নেই। অথচ সড়কপথের সবচেয়ে দামি গাড়িগুলো বিপুলসংখ্যক জানমালের দায়িত্ব নিয়ে তাদের চালাতে হয়। দেশব্যাপী হাজার হাজার বাস-ট্রাক চালকের কোনো নিয়োগপত্রই নেই। মাস শেষে তারা একটি নির্ধারিত অঙ্কের বেতন পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা এক দিন হয়তো হাজার, দেড় হাজার টাকা আয় করেন, অন্যদিন কোনো কাজই থাকে না। এসব ড্রাইভারের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। তারা মালিকদের নির্ধারিত টাকার দৈনিক চুক্তিতে গাড়ি চালান। ফলে বেশি ট্রিপ ও বেশি যাত্রী তোলার প্রবণতা থাকে ড্রাইভারদের মধ্যে। দিন শেষে মালিককে দিয়ে, তেলের খরচ, চাঁদার খরচ, সার্ভিসিংয়ের খরচ দিয়ে তাদের হয়তো সামান্যই হাতে থাকে। অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়তি আয়ের আকাক্সক্ষায় তারা চুক্তিতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। বেশি যাত্রীর জন্য রাস্তায় অন্য বাসের সঙ্গে রেষারেষি করে যাত্রী ও পথচারীদের চাপা দেয়।বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘নিয়োগপত্র না থাকায় পরিবহনশ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক সরকারি কল্যাণ তহবিলের টাকাও তুলতে পারেন না। পরিবহনশ্রমিকরা দৈনিক ১৮ ঘণ্টার বেশি পরিশ্রম করেও কোনো বাড়তি ভাতা পান না।’ তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো সময় মহাসড়কে ৪ ঘণ্টার রাস্তা যেতে ১৬ ঘণ্টাও লেগে যায়। কিন্তু এর জন্য মালিক কখনই শ্রমিককে ওভারটাইম দেন না। পরিবহনশ্রমিকরা কেউ বেতনভুক নন। তারা সবাই ট্রিপভিত্তিক চুক্তিতে কাজ করেন।’
স্টপেজে থামে না বাস : কুড়িল বিশ্বরোডে গতকাল সকাল ৯টার দিকে প্রায় ২০০ মানুষ অপেক্ষা করছেন কাকলী, বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, মিরপুর রুটের বাসগুলোর জন্য। একটি বাস দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলায় অন্য গাড়ি ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ দুই বাস দাঁড়ানোয় অন্য বাসগুলো রাস্তার মাঝে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে। ফলে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ানো যাত্রীরা একেক সময় একেক দিকে দৌড় দিচ্ছেন। বিকাশ পরিবহনের একটি বাস রাস্তার মাঝামাঝি দাঁড়ালে এক বয়স্ক ব্যক্তি দৌড় দেন বাসে উঠতে। হেলপার বাস থামানোর ইশারা দিলেও চালক তা খেয়াল না করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। কোনোরকমে হাতল ধরতে পারলেও পুরোপুরি উঠতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ ঝুলে থাকেন। অবশেষে পাশের যাত্রী কোনোরকমে হাত ধরে টেনে তুললে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান তিনি। একই চিত্র রাজধানীর কারওয়ান বাজারেও। গোলচত্বরে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে বাসে ওঠার অপেক্ষায়। শাহবাগ থেকে ফার্মগেটমুখী গাড়িগুলো কিছুটা গতি কমিয়ে যাত্রী তোলার চেষ্টা করে। ট্রাফিক পুলিশ এ জায়গায় গাড়ি থামাতে না দেওয়ায় কিছুদূর গিয়ে মাঝরাস্তায় বাস থামায় তারা। বাসে ওঠার জন্য ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকেন যাত্রীরা। এ জায়গায় প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও খেয়াল নেই যাত্রী ও চালকদের। নতুনবাজারে বাস থামার স্থান নির্ধারণ করে বানানো হয়েছে যাত্রীছাউনি। কিন্তু বাস স্টপেজে বাস না থামায় যাত্রীরাও এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাস্তায়। শুধু তাই নয়, ফ্লাইওভারের মুখে যাত্রী ওঠানো-নামানোর জন্য থামানো হয় গাড়ি। গত মঙ্গলবার দুপুরে দেখা যায়, মহাখালী ফ্লাইওভারের জাহাঙ্গীর গেট প্রান্তে বাসটি থেমে আছে। ঠিক ফ্লাইওভারের মুখেই এর পেছনে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করছে আরও দুটি গাড়ি। এতে দ্রুতগতির প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল চালকরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।
ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না যাত্রীরা : রাজধানীর নতুনবাজারে দ্রুতগতির বাসের সামনে হাত তুলে রাস্তা পার হচ্ছেন যাত্রীরা। অথচ ৫০ গজ দূরেই রয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। অল্প কিছু মানুষ ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হলেও অধিকাংশ মানুষই রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন। রাজধানীর অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজের চিত্রই এমন। সিটি করপোরেশন বিপুল টাকা খরচ করে রাজধানীজুড়ে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করলেও অসচেতনতার কারণে তা ব্যবহার করছেন না নগরবাসী। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকেই। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে অনেকেই দিয়েছেন জরিমানাও। এত কিছুর পরও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার বাড়ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ও পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুটওভার ব্রিজগুলোর উচ্চতা বেশি হওয়ায়, নোংরা পরিবেশ, হকার, ভিক্ষুক ও মাদকসেবীর দখলে থাকায় তারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না।
লেন মানেন না চালকরা : গত ৫ মে মোটরসাইকেল চালিয়ে উত্তরার দিকে যাচ্ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক। কাওলার কাছে পৌঁছালে হঠাৎ পেছন থেকে কদমতলী-উত্তরা রুটের একটি বাস মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে মোজাম্মেল গুরুতর আহত হন। বিমানবন্দর থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, বাস ও মোটরসাইকেল চালক কেউই লেন মেনে চলেন না। বিশেষ করে রাজধানীর গণপরিবহন চালকরা ইচ্ছামতো যাতায়াত করেন। তাদের বেপরোয়া আচরণে হামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত সোমবার কালশীতে তেঁতুলিয়া পরিবহনের দুটি গাড়ি বেশি যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। একবার ডানে একবার বাঁয়ের লেনে এঁকেবেঁকে গাড়ি চালানোয় আতঙ্কে চেঁচামেচি করতে শুরু করেন যাত্রীরা। অবশেষে স্টপেজে গিয়ে বাগ্বিত ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ প্রতিযোগিতা। দড়ি দিয়ে কিছু জায়গায় লেন আলাদা করে দিলেও তা মানছেন না চালকরা। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে নির্দিষ্ট লেনে না চলার কারণে।
ধীরগতির যানবাহনে ঘটছে দুর্ঘটনা : রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে সিগন্যালে বাস, মোটরসাইকেলের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় প্রায় ৩০টি যাত্রীসহ রিকশাকে। সিগন্যাল ছাড়তেই গিয়ার বাড়িয়ে ছুটে চলে বাসগুলো। বাসের গা-ঘেঁষে চলতে শুরু করে রিকশা। অনেক সময় ফাঁকফোকর গলে ডানে-বাঁয়ে হাত দেখিয়ে বাসের সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে রিকশা। কদম ফোয়ারা চত্বরে পৌঁছালে বাসের সামনে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী নিয়ে গোলচত্বর ঘুরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যায় রিকশাগুলো। আজমেরী পরিবহনের চালক লতিফ আলী বলেন, ‘মূল সড়কগুলোয় রিকশার কারণে চাইলেও গতি বাড়ানো যায় না। বিশেষ করে মোড়গুলোয় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় আমাদের। হঠাৎ করে রিকশা সামনে চলে এলে ব্রেক কষেও দুর্ঘটনা ঠেকানো যায় না।’