রবিবার, ১২ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিদেশে অবৈধ ১০ লাখ বাংলাদেশি

বৈধ করতে বাড়ানো দরকার কূটনৈতিক তৎপরতা

জুলকার নাইন

দেশে ফেরার জন্য আউটপাসের অপেক্ষায় আছেন ওমান প্রবাসী বাংলাদেশি রুবেল হোসেন। দেশে আসতে পারেননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চার বছর আগে ওমানে আসি। দালালদের কথায় ভিটেমাটি বিক্রি করে এখানে এসে দেখি আমার কাগজপত্র নেই। ৪০ হাজার টাকা বেতনে কাজের কথা বলে কোনো কাজই  দেওয়া হয়নি। অবৈধভাবে এখন পথে পথে ঘুরছি। না পাচ্ছি কোনো কাজ, না পারছি দেশে যেতে।’ আবেগাপ্লুত রুবেল বলেন, ‘সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে ওমান এসেছি। ভেবেছিলাম পরিবারে অভাব মোচন করতে পারব। কিন্তু এখানে এসে হতাশা ছাড়া কিছুই পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমার কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছি না।’ শুধু রুবেল নয়, বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে কাগজপত্রহীন বা ‘আন-ডকুমেন্টেড’ অবস্থায় অবৈধভাবে অবস্থান করছেন বাংলাদেশিরা। এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও জনশক্তি বাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। এর বেশির ভাগেরই অবশ্য ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভিন্ন পদ্ধতিতে ওসব দেশে গিয়ে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এসব বাংলাদেশি মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আমিরাতের মতো শ্রমঘন দেশগুলোতে যেমন আছেন, তেমনি আছেন উন্নত বিশ্ব হিসেবে পরিচিত ইউরোপ-আমেরিকাতেও। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতেই আছেন দেড় লাখের বেশি। শুধু স্পেনজুড়ে বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছেন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি। মালয়েশিয়ায় প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতারের আতঙ্কে থাকেন। সৌদি আরবে কাজ হারানো ও গ্রেফতার হয়ে দেশে ফেরার শঙ্কা আছে দুই লক্ষাধিক বাংলাদেশির। বিশ্ব রাজনীতির মারপ্যাঁচ ও নিজেদের দোষে বিপাকে পড়েছেন কাতারে থাকা তিন লাখ বাংলাদেশি। ভিসার সমস্যায় চরম সংকটে আছেন আরব আমিরাতে থাকা ৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে বসবাসরত ৯৩ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার চাপ কঠোর থেকে কঠোরতর করার চেষ্টা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপে যাওয়ার লোভে তুরস্ক গিয়ে পৌঁছানো হাজারো বাংলাদেশি সেখানে আছেন বন্দীদশায়। বিপদসংকুল জেনেও ইউরোপে যাওয়ার আরেক পথ হিসেবে লিবিয়াকে বেছে নেওয়া কয়েক হাজার ভাগ্যান্বেষী রয়েছেন চতুর্মুখী শঙ্কায়। অভিবাসন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ পথে অদক্ষ কর্মীদের প্রতারণার  মাধ্যমে বিদেশে পাঠানোর পথ ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে আসছে। এদের সবাই যে অবৈধ পথে বা মানব পাচারের শিকার হয়ে অবৈধ হয়েছেন তা নয়, বেশির ভাগই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আন-ডকুমেন্টেড হয়েছেন। শ্রমঘন দেশগুলোতে সাধারণ ক্ষমার আওতায় বিভিন্ন সময়ে বিশেষ সুযোগ পাওয়া গেলেও বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থানের সুযোগ কমে আসছে। এ কারণে বিশালসংখ্যক এই অভিবাসী বাংলাদেশিকে থাকতে হচ্ছে অনিশ্চয়তায়। সাধারণ ক্ষমার পর সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় থাকা অবৈধদের দেশ ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ায় গত চার মাসে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে ১৮ হাজার ৯১৫ জন বিদেশিকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে চার হাজার ২৯১ জন বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন কাতার প্রবাসীরাও। আসন্ন রমজান মাসে নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে কাতারজুড়ে চলছে অবৈধ শ্রমিক গ্রেফতার অভিযান।  এক্ষেত্রে গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বৈধ শ্রমিকরাও। গত তিন দিনের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩৭৫ জন দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে বুধবার ফিরেছেন ২১০ জন। তাদের মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৭৫ জন, ইরান থেকে ৪৫ জন, ওমান থেকে ৪৩ জন, কাতার থেকে ৪০ জন এবং লিবিয়া থেকে সাতজন। বুধবার রাত ২টায় সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন ১০৫ জন এবং বৃহস্পতিবার দুপুরে ইরান, ইরাক ও লিবিয়া থেকে ফিরেছেন আরও ৬০ জন কর্মী। মালয়েশিয়া প্রবাসী মজলুম আনোয়ারের দাবি, কেউ শখ করে বিদেশে গিয়ে অবৈধ হয় না। বিভিন্ন কারণেই বাধ্য হয়ে অবৈধ হতে হয়। তাই সরকার ও দূতাবাসের উচিত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো।  দূতাবাসগুলো শুধু শিক্ষিত ও উচ্চ স্তরের মানুষের পাশে থাকবে, অর্ধশিক্ষিত দরিদ্র শ্রেণির জন্য কিছুই করবে না- তা যেন না হয়।

সর্বশেষ খবর