রবিবার, ১২ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাঠ প্রশাসনে ক্ষমতার লড়াই

পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে নীরব দূরত্ব জনপ্রতিনিধিদের

নিজামুল হক বিপুল

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুলিশ ও মাঠ প্রশাসনের ক্ষমতা এবং প্রভাব দেশের অনেক জেলা, উপজেলায় বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক পর্যায়ে। অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির চেয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন বেশি খবরদারি করছেন। তারা কথা শুনছেন না জনপ্রতিনিধিদের। এমন কি অনেক জায়গায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরোয়া করেন না পুলিশ সুপারের। একইভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেলা প্রশাসকের নির্দেশ পেলে মুখে ‘হ্যাঁ স্যার, এখনই করে দিচ্ছি স্যার’ আওড়ালেও কাজের কাজ কিছু করেন না। অবশ্য জনপ্রতিনিধিদের আদেশ উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে পুলিশ একধাপ এগিয়ে। এ অবস্থায় মাঠ প্রশাসন এবং পুলিশের মাঠ পর্যায়ে রদবদল জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসনের লোকজনও মনে করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং চেইন অব কমান্ড বা শৃঙ্খলা ধরে রাখতে এখনই এটা দরকার। সাবেক আমলারা বলছেন, প্রশাসন ও পুলিশকে যত রাজনীতিকরণ করা হবে ততই এরকম সমস্যা বাড়বে। তাদের ওপর রাজনীতিকদের কর্তৃত্ব দিন দিন কমতে থাকবে। আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতিকরা তা হয়তো উপলব্ধি করছেন না। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ ও প্রশাসন। সরকারের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের চেয়ে তারা ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কাউকেই তোয়াক্কা করছে না। অনেক জায়গায় সংসদ সদস্যদের ঈঙ্গিত করে পুলিশকে বলতে শোনা গেছে, আমরা (পুলিশ) না থাকলে আপনি এমপি হতে পারতেন না। তাদের আনুকূল্য পাওয়াতেই সরকার গঠন হয়েছে এমন বড়াই করতেও দেখা যায় পুলিশকে। কোথাও কোথাও তো পুলিশ আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলতেও দ্বিধা করছে না। দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পুলিশের হাতেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা। কিন্তু তাদের শেল্টার দিতে পারছেন না দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা। পুলিশ মাঠপর্যায়ে দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের কথা শুনছে না। সম্প্রতি সচিবালয়ে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর দফতরে এসে আওয়ামী লীগের এক নেত্রী পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, তার নেতা-কর্মীদের অহেতুক বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে পুলিশ টাকা নিচ্ছে। জবাবে ওই মন্ত্রী অনেকটা নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, আমি কি করব! এ অবস্থা এখন সারা দেশেই চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় মাঠ প্রশাসনে বিশেষ করে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদে এখনই রদবদল করা জরুরি বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুলিশ যে হারে ক্ষমতা প্রয়োগ করছে তাতে মনে হচ্ছে তাদের ছাড়া সরকার পুরোপুরি অচল। তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে পুঁজি করে পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বেপরোয়া। তারা তাদের কাজের পরিধিটুকু পর্যন্ত ভুলে গেছে। ওই কর্মকর্তার মতে, মাঠ প্রশাসন এবং পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে একটা রদবদল এখন জরুরি। নির্বাচনের চার মাস পার হয়ে গেছে। এ মুহূর্তে এই পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এতে করে মাঠে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। নইলে অনেক খেসারত দিতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, পুলিশ সুপার পদে পদায়ন পাওয়ার পর ওই কর্মকর্তা সাধারণত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত একটি কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তবে কোনো অভিযোগ উঠলে তাকে বদলি করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে আগের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা পদায়ন করে থাকে। কিন্তু এর ব্যতয় ঘটছে গত ২০১৪ সাল থেকে। ওই বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর জেলা পর্যায়ে প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা দেওয়া হয়নি। যার ধারাবাহিকতা গত নির্বাচনের পরও বহাল আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ধারাবাহিক হওয়ার কারণে নির্বাচনের পর পরই মাঠ পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরই ডিসি, এসপি, ইউএনও বদলি বা প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এদিকে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের অনেক জেলায় ইউএনও আদেশ মানছেন না জেলা প্রশাসকের। আবার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (পরিদর্শক) মানছেন না এসপিকে। উপরে উপরে সব কিছু ঠিকঠাক দেখালেও ভিতরে ভিতরে তাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশাসনের রদবদল একটা রুটিন ওয়ার্ক। সাধারণত একজন একই কর্মস্থলে দুই থেকে তিন বছর থাকার পর বদলি হন। তবে সরকার পরিবর্তন হলে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনে রদবদল দেখা যায়। কিন্তু বর্তমান সরকার নিয়মিত হওয়ায় নির্বাচনের পর পরই রদবদল দেখা যায় না। পুলিশ ও প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রশাসন ও পুলিশকে যত বেশি রাজনীতিকরণ করা হবে তত বেশি সমস্যার সৃষ্টি হবে। তখন রাজনীতিকদের কর্তৃত্ব ক্রমান্বয়ে কমে যাবে। যদিও তাদের কাছে মনে হবে সব কিছু ঠিক আছে। তিনি বলেন, প্রশাসন ও পুলিশ ক্ষমতাবান হয়ে উঠলে শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। চেইন অব কমান্ড ব্যাহত হয়, তিনি বলেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই ইউএনও ডিসিকে এবং ওসি এসপিকে মানেন না। এতে করে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্বল হয়।

সর্বশেষ খবর