রবিবার, ১২ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার দুই নারী ও পাঁচ শিশু

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশে ধর্ষণ এখন ‘মহামারী’তে রূপ নিয়েছে। অবস্থা এতই শোচনীয় যে বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পাঁচজন শিশু। আর পৈশাচিক এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দুজন নারী। ধর্ষকদের কুপ্রবৃত্তি ও লালসা থেকে রেহাই পাচ্ছে না দুধের শিশু, মাদ্রাসাশিক্ষার্থী, প্রতিবন্ধী শিশুর কেউই। ধর্ষক বাবা ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের মেয়েকেই দিনের পর দিন ধর্ষণ করছে। কন্যাশিশু তো বটেই, ধর্ষকরা ছাড়ছে না ছেলেশিশুদেরও। ঘরের বাইরে বের হওয়া সব বয়সী কন্যাশিশু, কিশোরী, মধ্যবয়সী নারী ও তরুণীদের ‘খুবলে’ খাচ্ছে ধর্ষক। ঘরের মধ্যে থাকা শিশুরা এখন ধর্ষকের কাছ থেকে বাঁচতে পারছে না। অপরাধ ঢাকা দিতে ধর্ষকরা আবার পৈশাচিকভাবে হত্যা করছে ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীদের। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) মোট ২৮৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ৩৫ জন। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী ১৪ শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণ শেষে ১৬ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। আর ধর্ষণের পর ১০ জন শিশু আত্মহত্যা করে। মানবাধিকার সংগঠন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মে মাসের প্রথম আট দিনেই ৪১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে পাঁচজনের মতো শিশু প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার এই শিশুদের মধ্যে মেয়েশিশুর সংখ্যা ৩৭ আর ছেলে চারজন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, শুধু জানুয়ারিতেই ৫২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এ হিসাবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় দুজন (১.৭৩) নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হন ২২ জন এবং ধর্ষণের পর চারজন নারীকে হত্যা করা হয়। আর পুরো ২০১৮ সালে মোট ধর্ষণের শিকার হন ৯৪২ জন নারী। ওই বছর গণধর্ষণের শিকার হন ১৮২ জন আর ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় ৬৩ জন নারীকে। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ধর্ষণের প্রতিবেদন, মানবাধিকার সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক নারী ও শিশু থানায় হেনস্তার শিকার হয়। এ-সংক্রান্ত মামলার রেকর্ড গুরুত্ব দিয়ে নেওয়াও হয় না। অভিযোগ আছে, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের ধরতে পুলিশের উদাসীনতা কাজ করে। উদ্বেগজনক যে, ধর্ষণ মামলার আসামিরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে বিশেষজ্ঞরা ‘উদ্বেগজনক’ মন্তব্য করে বলেন, ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলায় গাফিলতি আছে এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রমাণিত হলেই তাকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশে যতগুলো ধর্ষণ মামলা বিচারাধীন আছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তার বিচারকাজ শেষ করতে হবে। এ জন্য স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ষণ উসকে দেয় এমন পোস্টদাতাদের মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। ধর্ষণের ঘটনা যাতে না ঘটে এ জন্য প্রতি এলাকার জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মানবাধিকারকর্মী ও নারীনেত্রী খুশী কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে উদ্বেগজনক হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী পুলিশ প্রশাসন। সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে নারীকে ভুল উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের অপরাধ কমাতে পুলিশ বাহিনীকে ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সঙ্গে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত অপরাধীদের সঠিকভাবে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ-সংক্রান্ত বিচারের ক্ষেত্রে যাতে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক মমতাজ বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাজে ‘মহামারী’ আকারে যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা চিন্তা করা যায় না। ছোট শিশু থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী নারী কেউই ধর্ষকের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সমাজের এই অনৈতিক অবস্থা থেকে উত্তরণ তথা আমাদের শিশু, কিশোরী ও নারীদের রক্ষা করা শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ রক্ষায় সবাই যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, একইভাবে নারী-পুরুষ প্রত্যেককে ধর্ষণের ‘মহামারী’ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, সারা দেশে ধর্ষণ একরকম ‘মহামারী’তে রূপ নিয়েছে। পৃথিবীর অন্য দেশেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে কিন্তু এ রকম মহামারী রূপ নেয় না। এমনকি ধর্ষকরা আলামত গোপন করতে ভুক্তভোগীকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে। ধর্ষকরা অশ্লীল সিনেমা ও পর্নোগ্রাফি দেখে এ ধরনের অপরাধে ঝুঁকছে। এই মহামারী থেকে দেশকে বাঁচাতে গ্রাম থেকে বস্তি- সর্বত্র রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ও এনজিও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ধর্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ধর্ষণের সাজা সম্পর্কে সারা দেশে লিফলেট বিতরণ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর