শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক চাপ সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর বেশি

মাহমুদ আজহার

রাজনৈতিক চাপ সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর বেশি

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর এখন আগের চেয়ে রাজনৈতিক চাপ বেড়েছে। অনেক বিষয়ে যেগুলো কারিগরি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, এখন সেগুলোয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাব বিস্তার করছে। তিনি বলেন, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানেই এখন দক্ষ ও যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে শুনানি হওয়া জরুরি। সেখানে তাদের দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়ে যাচাই-বাছাই করতে হবে, আলাপ-আলোচনা হতে হবে। এতে অপেক্ষাকৃত যোগ্য লোকেরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ পাবে বলে আমার বিশ্বাস।

গত রবিবার রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আকবর আলি খান এসব কথা বলেন।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দূরীকরণ প্রসঙ্গে সাবেক এই অর্থসচিব বলেন, ‘এতে লাগাম টেনে ধরা খুবই সহজ। এটা করতে হবে সরকারকেই। তারা চাইলেই সব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ হবে। না চাইলে এই অবস্থা চলতেই থাকবে।’ টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের পাঁচ মাস সরকার পরিচালনায় কোনো পরিবর্তন হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গতানুগতিক ধারায় দেশ পরিচালনা দেখছি। ব্যতিক্রম কোনো কিছুই দেখছি না।’ বিএনপি সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হলো, ‘এ দলটির ভিতরে-বাইরে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। দলটি ঐক্যবদ্ধ নয়। এটা মোটেও ভালো ইঙ্গিত নয়।’

৭৫ ঊর্ধ্ব এই শিক্ষাবিদের এখনো সময় কাটে পড়াশোনা, লেখালেখি আর শিক্ষকতায়। তিনি জানালেন, শারীরিক অবস্থা ভালো নেই। দিন দিন খারাপই হচ্ছে। তার পরও তার হাতে একদম সময় নেই। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি আগামী বইমেলায় প্রকাশের জন্য দুটি বই লিখছেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যোগদান করছেন প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ। খোলামেলা আলাপচারিতায় সরকার-বিরোধী দল ছাড়াও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিয়ে নিজের আশাবাদের কথাও জানান ড. আকবর আলি খান। তিনি বলেন, ‘তরুণদের নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী। তাই এখন যত সমস্যাই থাকুক না কেন, তরুণরা দেশকে এগিয়ে নেবেই। দেশ এগিয়ে যাবেই।’

ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে আলাপচারিতার চুম্বক অংশ সাক্ষাৎকার আকারে তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বর্তমানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়করণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. আকবর আলী খান : সবাই জানে, সরকারও বলে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালোভাবে কাজ করা উচিত। নাগরিক সমাজও একই কথা বলছেন। এর বাইরে আমার ভিন্ন কোনো মত নেই। তবে সব প্রতিষ্ঠানেই দক্ষ ও যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে। আমি এ জন্যই বলি, এসব প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে হিয়ারিং হতে হবে। সেখানে তাদের যোগ্যতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। এতে অপেক্ষাকৃত যোগ্য লোকেরা নিয়োগ পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। এসব সেক্টরের লাগাম টেনে ধরা যায় কীভাবে?

ড. আকবর আলি খান : দুর্নীতির লাগাম টানা সহজ। সরকার চাইলেই এসব দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। না চাইলে চলতেই থাকবে। অতীতেও এমনটি হয়েছে। যখন সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন থেকেছে তখন এ সমস্যা বেড়েছে। সরকার যখন সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে, তখন এটা কমে এসেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

ড. আকবর আলি খান : অর্থনীতির খারাপ-ভালো দুটো দিকই আছে। ভালো দিক হলো, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এখনো সন্তোষজনক। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি অল্প কয়েকটি খাতের ওপর নির্ভরশীল। যেমন গার্মেন্ট খাত বা বিদেশি জনশক্তি রপ্তানি খাতে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর আমরা অনেক বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছি, এগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারি, তাহলে এগুলোও আমাদের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে জন্য অর্থনীতি একদিকে যেমন আশাব্যঞ্জক ধারায় রয়েছে, অন্যদিকে যেসব ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

ড. আকবর আলি খান : এটা মূল্যায়ন করতে হলে কোন সংসদীয় আসনে কত ভোট পড়েছে, কোথাও ভোটের ক্ষেত্রে দেখা যাবে, যে পরিমাণ ভোট পড়ার কথা তার চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আমি এ নিয়ে কোনো গবেষণা করিনি। তবে গণমাধ্যমে দেখেছি, বিরোধী দলগুলো থেকে অনেক মামলা রুজু করা হয়েছে। সেই মামলাগুলোর ফলাফল কী হয় তা দেখতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নতুন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ মাসেরও বেশি সময় হতে চলল। সরকারের এ সময়ে দেশ পরিচালনা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ড. আকবর আলি খান : এ নিয়ে আমার কোনো মূল্যায়ন নেই। তবে গতানুগতিক ধারাই দেখছি। ব্যতিক্রম কোনো কিছুই দেখছি না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সম্প্রতি বিএনপির পাঁচ এমপি শপথ নিয়েছে। এ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে ছাড়াও তাদের মিত্র ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ঐক্যফ্রন্টের ৭ জনের শপথকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. আকবর আলি খান : বিএনপি বর্তমানে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গত সংসদ নির্বাচনের পরে বিএনপি এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নিয়ে আসতে পারেনি। তাদের দলের মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। এটা ভালো নয়। বিএনপিকে এক সিদ্ধান্তে থাকতে হবে। দলের মধ্যে যে ভিন্নমত দেখা যাচ্ছে, তা মোটেও ভালো ইঙ্গিত নয়। সুতরাং বিএনপিকে যদি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে হয়, তাহলে তাদের পুনর্গঠন করে দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। অন্যথায় বিএনপির সামনে ভালো কিছু নেই।

বিএনপির কয়েকজন শপথ নিয়ে সংসদে গেছেন। তাদের একপক্ষ বলছেন, যাওয়া উচিত ছিল। আরেক পক্ষ বলছেন, উচিত হয়নি। বিএনপির এক নেতা শপথ নেননি। অন্যরা গেছেন। এতে দলের ভিতরই বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। কেউ গেলেন কেউ গেলেন না এটা ঠিক না। একই দলে যদি দুই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন। ওই সময় সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে শিক্ষকতায় গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু  আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে চাননি কেন?

ড. আকবর আলি খান : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিতভাবে আমাকে বলেছেন, আমি শিক্ষকতা করতে পারব, তবে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ নয়। এটা বঙ্গবন্ধু নিজে হাতে লিখে এই আদেশ দিয়েছিলেন। এটা সরকারি কোনো নোটেও ছিল না, আমিও কোনো আবেদন করিনি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি তো সরকারের একজন আমলা ছিলেন। বিশেষ করে অর্থসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। আপনার সময়কার সরকারি কর্মকর্তা আর বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কি?

ড. আকবর আলি খান : বর্তমান আমলারা কীভাবে কাজ করেন, আমি সে সম্বন্ধে অবহিত নই। কারণ আমি সরকারি অফিসে ঘোরাঘুরি করি না। আমি জানি না তারা কীভাবে কাজ করছেন। তবে বাইরে থেকে যেটা মনে হয়, রাজনৈতিক চাপ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। অনেক বিষয়ে যেগুলো কারিগরি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো সেগুলোতে এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেশ যেভাবে চলছে তাতে আপনি বাংলাদেশ নিয়ে কতটুকু আশাবাদী?

ড. আকবর আলি খান : বাংলাদেশ নিয়ে আমি সব সময় আশাবাদী। আমরা অনেক কিছু করতে পারিনি, আবার অনেক কিছু করেছিও। বাংলাদেশ নিয়ে এ জন্যই আশাবাদী। এ দেশ হলো তরুণদের। এখানে জনসংখ্যার বড় অংশই হলো তরুণ। তারা তাদের মতো করে দেশ গড়ে তুলবেই। এখন যতই সমস্যা থাকুক না কেন বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বর্তমানে আপনার সময় কীভাবে কাটে?

ড. আকবর আলি খান : আমার একদম সময় নেই। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। বই লেখালেখি করি। গত বই মেলায় ২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। আগামী বইমেলায় প্রকাশের জন্য দুটি বই লিখছি। এটা কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৪০০ পৃষ্ঠার বই হবে। বই লেখাই আমার দ্বিতীয় কাজ। তার পরে এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হয় অসুস্থ শরীর নিয়ে। এসব মিলিয়ে অতিরিক্ত কোনো কাজ করতে পারি না। আমি অসুস্থ। আমার শারীরিক অবস্থা প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে। এরপরও  যেটুকু করতে পারছি তাতে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. আকবর আলি খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর