সোমবার, ২০ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

চরম হতাশায় ভালো ব্যবসায়ীরা

ঋণখেলাপিরা সুবিধা পেলেও ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন হয়নি

নিজস্ব প্রতিবেদক

খেলাপি ঋণ নিয়মিতকরণ (রেগুলারাইস) করতে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ সুবিধা পাবেন সব খেলাপি। যারা ঋণখেলাপি হলেন তাদেরকেই সুবিধা দেওয়া হলো। অথচ ব্যাংক ঋণের সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি গত ১০ মাসে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকটি সার্কুলার দিয়ে ভালো ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঋণের মোট সুদের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় পাওয়ার যে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে তা খুবই সামান্য। এ জন্য যারা ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে আসছেন তাদের জন্য সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। কেননা নিয়মিত গ্রাহকরা নিজেদের অনুকূলে নেওয়া ব্যাংক ঋণ ১৩ বা ১৪ এমন কি ১৫ শতাংশ সুদে পরিশোধ করছেন। আবার অনেকেই এমন উচ্চ সুদ হারে ঋণ পরিশোধও করে ফেলেছেন। অথচ ঋণখেলাপিরা মাত্র ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেলেন। যা প্রকৃত ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। এদিকে কিছু পণ্য ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেডিং খাতে গম, জাহাজ ভাঙ্গা, ইস্পাত শিল্প রয়েছে। গম আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তরা এই পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়ে নতুন করে আবারও ঋণ নেবেন। যা পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে যাওয়ার পরেও বেশি দামের এলসি খোলার অভিযোগ আগেই রয়েছে। এখন আবার নতুন করে তারা এলসি খুলে ওভার ইনভয়েস করে অর্থ পাচার করবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে যারা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি হওয়া ঋণ ৯ শতাংশ সুদে পরিশোধের সুযোগ পেলেন তাদেরকে অন্তত তিন বছরের জন্য পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা তারা পুরনো খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার পর আবার নতুন করে ঋণ নিচ্ছেন কিনা সেই বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। কেননা নতুন করে নেওয়া সেই ঋণের অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে নতুন করে বিনিয়োগ আসা আবারও বাধার মুখে পড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার কেউ কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত এই সুযোগ নিয়ে অপব্যবহার করতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, নতুন সুবিধায় খেলাপিরাই বেশি লাভবান হবেন। যা ব্যাংক খাতের সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে। এ ছাড়া সাময়িক সময়ের জন্য সমাধান বলে মনে হলেও এটা ভবিষ্যতের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। উল্লেখ্য, গত ১৬ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়মিতকরণের সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন খেলাপিরা। ঋণ পুনঃতফসিল হওয়া ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবেন পরবর্তী ১০ বছর। এ ক্ষেত্রে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হবে না গ্রাহকদের। যা গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে গণ্য হবে। ব্যবসায়ীরা জানান, ঋণ খেলাপিরা অর্থ পরিশোধে সময়ও পাচ্ছেন এবং ঋণের সুদও কম দিতে হচ্ছে। আর যারা নিয়মিত ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে আসছেন তাদের ব্যাংকের সুদও বেশি দিতে হচ্ছে, সুবিধাও পাবেন কম। এতে ব্যাংকের অর্থ সময়মতো পরিশোধ করার চাইতে আটকে রাখাই ভালো। যারা ব্যাংকে খেলাপি হচ্ছেন তারাই ভালো আছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত সিঙ্গেল ডিজিট (৯ শতাংশ) সুদ হারের সিদ্ধান্ত গত দশ মাসেও কার্যকর করেনি বেসরকারি খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনো ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য প্রধান অন্তরায় বলে মনে করা হচ্ছে। সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ নজরদারি করা হচ্ছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। যেসব ব্যাংকের এমডি এখনো ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে অনীহা প্রকাশ করেছেন, তাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায় থেকে কথা বলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটা অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককেও অবহিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংক মালিকদের সংগঠন (বিএবির) পক্ষ থেকেও ব্যাংকের এমডিদের ওপর ঋণের সুদ কমাতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারছে না কেউই। সূত্র জানায়, সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হারের ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেউ বাস্তবায়ন করছে না। বরং উল্টো গত দু-তিন মাসে সুদের হার বেড়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট সুদের হার কমাতে দিচ্ছে না। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এর মধ্যে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ তহবিল বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করা এবং এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ করা হয়েছিল। তারপরও ঋণের সুদহার বাড়ছে এবং তা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে সরকারের এমন একটি ইতিবাচক পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি কিংবা বিদেশি সব খাতের ব্যাংকই ঋণের সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে। গত মার্চ-এপ্রিলে দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৪৪টি ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়িয়েছে। দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সব কটিতেই এখন দুই অঙ্কের সুদ গুনছেন ব্যবসায়ী ও ঋণগ্রহীতারা। বর্তমানে শিল্পঋণ পেতে ব্যবসায়ীদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে। যা বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। যেসব ব্যবসায়ী শত কষ্টে নিয়মিত ব্যাংক ঋণের অর্থ পরিশোধ করেছেন, এমন ভালো ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ কর সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। তার মতে, ভালো ব্যবসায়ীরা ঋণ পেতে অনেক কষ্ট পান। এই সংকট উত্তরণে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তিনি দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে কমিয়ে আনতে সরকারের পদক্ষেপ দেখতে চান। তিনি বলেন, যেসব ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন কিন্তু ঋণখেলাপি হননি, সেসব ভালো ব্যবসায়ীর জন্য বিশেষ কর সুবিধা চাই। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা ইচ্ছে করে ঋণখেলাপি হয়েছেন তারা ভবিষ্যতে ভালো হয়ে যাবেন এটা কেউ বিশ্বাস করবেন না। এ ঋণ খেলাপিরা সুবিধা নিয়ে নিজেদের ঋণ নিয়মিত করে আবারও ঋণ নেবেন। যে টাকা ডাউন পেমেন্ট দেবেন। করপোরেট গ্যারান্টি দিয়ে তারা বেশি ঋণ নেবেন। পরে কী হবে। আবারও তারা খেলাপিতে পরিণত হবেন। তাই সুবিধা দেওয়ার পর এসব ব্যবসায়ীকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তারা ভালো হয়েছেন নাকি একই রয়ে গেছেন। এক-দুই বছরের মধ্যে তারা কোনো ঋণ পাবেন না। কিস্তি পরিশোধ তারা করছেন কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জামালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশেষ অডিট করে ঋণ খেলাপি বাছাই করা হবে। কারা ইচ্ছাকৃত আর কারা জেনুইন বা সমস্যায় পড়ে খেলাপি হয়েছেন। এটা যদি থার্ড পার্টি দিয়ে যাদের সক্ষমতা আছে তাদের দিয়ে অডিট করানো হয় তাহলে ভালো হবে। কিন্তু ঢালাও বা যদি প্রতিষ্ঠান নিজেই অডিট করে তাহলে প্রভাবিত হয়ে খেলাপি নির্ধারণ করা হবে। তাতে সমাধান তো হবেই না। বরং জটিলতা আরও বাড়বে।

সর্বশেষ খবর