বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বন্ড সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে চার লাখ দেশি প্রতিষ্ঠান বিপর্যয়ে

সাঈদুর রহমান রিমন

বন্ড সিন্ডিকেটের অন্যতম মাফিয়া পুরান ঢাকার সেই আবুল হোসেনের এবার দম্ভোক্তি ‘কাস্টম মাইর খাইছে এবার তোরাও (সাংবাদিকদের) মাইর খাবি। তোরা ইজ্জত নিয়া সইরা থাক- খামোখা মাইর মুইর খাইস না।’

বন্ডের অপব্যবহারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করাসহ দেশীয় শিল্প খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম হোতা হিসেবে সম্প্রতি বিতর্কিত হয়ে ওঠা আবুল হোসেন এখন সাংবাদিক দেখলেই ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, এখানে পেপার অ্যাসোসিয়েশন আছে-পারমিশন ছাড়া কিছুই করবা না। ভিডিও করলেও নিজেদের জায়গায় গিয়ে করো। ‘বন্ড সুবিধাভোগী’ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লাগামহীন দৌরাত্ম্যে দেশের ছোট-বড়-মাঝারি শিল্পের প্রায় চার লাখ প্রতিষ্ঠান বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কমবেশি ১০ লাখ কর্মীর পেটে পড়েছে লাথি। প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে মালিক, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীসহ লাখ লাখ পরিবারের জীবনযাত্রা অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়েছে। বন্ডকেন্দ্রিক বাণিজ্যের হোতারা দেশীয় শিল্প খাতকে শুধু বিপর্যয়ে ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সার্বিক অর্থনৈতিক খাতেও বড় আকারের ধস সৃষ্টি করে চলেছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের দুর্বৃত্তরা ‘বন্ড অপব্যবহারের’ মাধ্যমে প্রতিবছর সরকারের ৫৮ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিচ্ছে। আবার বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির নামে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করারও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

দেশের শিল্প ও অর্থনৈতিক খাত বিশেষজ্ঞরা বন্ড সুবিধাভোগী কতিপয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতাকে ‘ভয়ঙ্কর ডাকাতদের বেপরোয়া লুটপাট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, বন্ড দুর্বৃত্তদের নানামুখী লুটপাটের টাকায় বছরে দুটি করে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করা সম্ভব। বৃহত্তর ব্যবসায়ী সংগঠন ও শিল্প খাতের কর্ণধাররা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, অবিলম্বে এ দুর্বৃত্তপনা রুখতে হবে, তা না হলে ভয়াবহ সর্বনাশ ঘটে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ড লাইসেন্সধারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের অবৈধ কর্মকা- বাধাহীনভাবে চালিয়ে আসছে। এতে করে সরকার কোটি কোটি টাকার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হলেও কোনোভাবেই অসাধু চক্রকে দেশবিরোধী কর্মকান্ড থেকে নিবৃত করা যাচ্ছে না।

সূত্র জানাচ্ছে, ব্যবসায়ীদের দাবি আমলে নিয়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে জোর দিয়ে কাজ করছে। অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে বাজারজাত করা বিপুল পরিমাণ মালামাল জব্দ করা হয়েছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউসের ১৩টি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, ১৭টি কোম্পানিকে শো-কজ এবং ২৯টি লাইসেন্স স্থগিতও করা হয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্য ও রড বন্ড সুবিধায় আমদানি করা যায়। তবে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্যের ৯০ শতাংশই কাপড়, সুতা, কাগজ ও প্লাস্টিকজাতীয় পণ্য। বন্ড দুর্নীতি এসব খাতকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। কাগজ, প্লাস্টিক, কাপড়, সুতা, রডসহ বিভিন্ন খাতে বন্ডের অপব্যবহার হচ্ছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে বিদেশি সুতা, কাপড়ের অবাধ আমদানি হচ্ছে দেশে। ফলে মার খাচ্ছে দেশি টেক্সটাইল খাত। আরেকটি চক্র দেশে অবাধে আনছে ফিনিশড টাইলস। বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধার নামে সম্পূর্ণ তৈরি বা ফিনিশড টাইলস আমদানি করে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন। সম্প্রতি এ রকম একটি অসাধু চক্রের সন্ধান পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। তারা বন্ড সুবিধার আওতায় (বিনা শুল্কে) কাঁচামালের নামে তৈরি করা পণ্য বা ফিনিশড সিরামিক নিয়ে এসেছে। এরপর তা খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। বন্ড সুবিধার আওতায় আনগ্লেজড-আনপলিশড টাইলস আমদানির পর সেটি পলিশ করেও খোলাবাজারে বিক্রি করার ঘটনা ঘটছে।

বন্ড সুবিধা নিয়ে অর্থ পাচার : ছোট-বড় চার হাজার ৫৮টি প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার আওতায় কাঁচামাল আমদানির নামে অর্থ পাচারে জড়িত বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। অস্তিত্বহীন ৪৭৭টি প্রতিষ্ঠান দুই বছরে পাচার করেছে ৭৮৯ কোটি ২২ লাখ টাকা। উৎপাদনে থাকা ৫৬২ প্রতিষ্ঠানও এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা পাচার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়েও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন দুই হাজার ২৩৫টি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে অসাধু ব্যবসায়ীরা চার হাজার ২৩৪ কোটি ৯২ লাখ চার হাজার ৩০৮ টাকা দেশ থেকে পাচার করেছে। অর্থ পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত দুই হাজার ২৩৫ প্রতিষ্ঠানকে বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাদের ব্যবসার লাইসেন্সও স্থগিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫৭টি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের ১৯৩ জন পরিচালকের এবং ৪৮ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির নামে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের কর্মকা- থেমে নেই।

সর্বশেষ খবর