রবিবার, ২৬ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

কোনোভাবেই করের বোঝা চাপানো হবে না

কালের কণ্ঠের ‘কেমন বাজেট চাই’ গোলটেবিল বৈঠকে অর্থমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

কোনোভাবেই করের বোঝা চাপানো হবে না

রাজধানীর বসুন্ধরায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ কনফারেন্স হলে গতকাল কালের কণ্ঠ আয়োজিত কেমন বাজেট চাই গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আগামী বাজেটে কোনোভাবেই কারও ওপর করের বোঝা চাপানো হবে না। এক টাকাও কর বাড়ানো হবে না। তবে করের আওতা বাড়ানো হবে। যারা করের বাইরে রয়েছেন তাদের করের আওতায় আনা হবে। গতকাল ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স হলে কালের কণ্ঠ আয়োজিত কেমন বাজেট চাই গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, স্বাগত বক্তব্য দেন নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ভয়ের কোনো কারণ নেই। যদি আমাদের অর্থনীতি এতই খারাপ হবে তাহলে গত পাঁচ বছরে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পাঁচ দেশের মধ্যে সবার ওপরে বাংলাদেশ কীভাবে গেল। বিশ্বব্যাংক বলছে, ব্লুমবার্গের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে ৩০০ ডলার বেশি হবে। তাহলে এগুলো কীভাবে সম্ভব হলো?’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে যে দুরবস্থা, ঋণখেলাপি- এগুলো কেন হলো? ঋণখেলাপি আজকের সৃষ্টি নয়। ব্যাংক খাতের জন্মলগ্ন থেকে ঋণখেলাপি হয়ে আসছে। একবার তো ব্যালান্স শিট ক্লিন করার চেষ্টা করা দরকার। একের পর এক ঋণ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদ ১০ শতাংশ হলে হিসাব করা হয়েছে ১৬ শতাংশ করে। এগুলো যতটা পারা যায় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ ধরা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আটকা পড়লে কোনো এক্সিট ক্লোজ রাখা হয়নি। যে আইন করা হয়েছিল তাতে কেউ কখনো হাত দেয়নি। আর যখন করা হয়েছিল তখন ঋণখেলাপি নামে বোধহয় কোনো নিয়মই ছিল না। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার। অর্থনীতিবিদরা যে পরামর্শ দিয়েছেন তা আমরা নেওয়ার চেষ্টা করব।’ ট্যাক্স ও ব্যাংকিং খাতের জন্য পৃথক কমিশন গঠন করা হবে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, ‘কমিশন গঠনের যে দুটি প্রস্তাব এসেছে সেগুলো আমরা করব। একটি নয়, দুটি কমিশন গঠন করা হবে। ফিন্যানশিয়াল সাইড দেখার জন্য একটি কমিশন হবে আর রাজস্ব সাইড দেখার জন্য আরেকটি কমিশন।’

তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের জন্য ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার যে রাজস্ব ধরেছি তা অর্জন সম্ভব হবে। এটা ডাবল করা সম্ভব। আমাদের ইনফরমাল সেক্টর আছে। সেটাকে যুক্ত করলে সেফটিনেট আরও বেড়ে যায়। সুতরাং আমরা এবার রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট দিচ্ছি তা এক টাকাও কমবে না (সংশোধিত বাজেটে)। এবারের বাজেট হবে সহজ বাজেট। আমি খুব কম কথায়, সহজভাবে একটি বাজেট দেব। সেখানে কাউকে কোনোভাবেই আর বেশি কষ্ট দিয়ে কর আদায় করব না। তার পরও যদি কেউ বিপদে পড়েন, বাজেট যদি দিয়েও দিই তার পরও কেউ এসে অভিযোগ করলে তা পরিবর্তন হবে। বাজেটের পর একজন এসে অভিযোগ করতে পারবেন না যে, বাজেটের পর একটা জিনিসের দাম বেড়েছে। যা পেয়েছেন তা আরও বেশি করে পাবেন। আমি চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন জায়গায় আরও কিছু দেওয়ার জন্য।’

মন্ত্রী বলেন, ‘বিদেশে যে মাল যায়, যে মাল আসে এগুলো কী আসে আর কী যায় তা আমরা সত্যিকারভাবে জানি না। এখানে কতটা ওভার ইনভয়েসিং হয় আর কতটা আন্ডার ইনভয়েসিং হয় তাও দেখার ব্যবস্থা নেই। এখন থেকে শতভাগ মালামাল স্ক্যানার মেশিনের ভিতর দিয়ে আসবে। নৌ, স্থল- সব বন্দরে এটা কার্যকর হবে। আমরা এগুলো বন্ধ করতে পারলে অনেক দূর এগোতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে অনেক ফ্ল্যাট আছে। কিন্তু এগুলো রেজিস্ট্রেশন হয় না। রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি এত বেশি যে কেউ রেজিস্ট্রেশন করবে না। আমরা এগুলোয় যদি একটু সহনশীল হই তাহলে অনেক লাভ হবে। রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিতে ৮২০ শতাংশ ট্যাক্স! এটা কেন? এত তো ঠিক নয়। আমরা গাড়ির নম্বর প্লেট অকশনে তুলব। এটা থেকে কিছু টাকা আসবে। এটা হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় করে।’

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান, বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক, বারভিটা সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন, বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলালউদ্দিন, নারী উদ্যোক্তা সেলিমা আহমাদ এমপি, এসিআই লজিস্টিকসের প্রধান নির্বাহী সাব্বির হাসান নাসির, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী, পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আজম জে চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল মুক্তাদির, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এম শামসুল আলম। উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন, পিপিপি কার্যালয়ের প্রধান নির্বাহী আলকামা সিদ্দিকী প্রমুখ।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাকে কর কমানোর কথা বলা হচ্ছে। মন্ত্রীকে বলেছি, আমরা আশপাশের দেশ থেকে বেশি কর নিই না। ব্যক্তি খাতে যদি ন্যূনতম করহার কিছু কমাই তাহলে কি মানুষ লাইন ধরে কর দিতে আসবে? মানুষ কিছুদিন পরপর মোবাইল বদলায় কিন্তু বছরে মাত্র ৫ হাজার টাকা কর দিতে চায় না। বাংলাদেশে বাধ্য না করলে ইচ্ছা করে কেউ কর দিতে আসবে না। রাজস্ব বাড়াতে করের আওতা বাড়াতে হবে। তবে এজন্য রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনবল বাড়াতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে কাউকে বেশি ভ্যাট দিতে না হয়। এজন্য নতুন ভ্যাট আইন আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তবায়ন করা হবে।’

করব্যবস্থা সংস্কারের জন্য ন্যাশনাল ফিন্যান্স কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়ে অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে পত্রপত্রিকায় যেসব লেখা এসেছে তাতে প্রক্রিয়াটিকে বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। এজন্য কমিশন গঠন করে করকাঠামো সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। করবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ও একটা বড় ব্যাপার। দুর্নীতি, অদক্ষতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ- নানা কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন। দিনের পর দিন ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বলা হয় ঋণ আদায় হয় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। এগুলোর মাধ্যমে আয়বৈষম্য কমে আসবে।’ ফরাস উদ্দিন বলেন, ট্যাক্স রেট কমিয়ে দিলে রাজস্ব আদায় বাড়বে। এ ছাড়া অর্থবছর জুন-জুলাইয়ের পরিবর্তে জানুয়ারি-ডিসেম্বর করা এবং শুক্রবার-সোমবার সপ্তাহ ঘোষণার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনকে হত্যা করেছি। এজন্য আর্থিক খাতের মূলনীতি থেকে আমরা সরে গেছি। এজন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।’

সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতের দুরবস্থা কাটাতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। ব্যাংক খাতের সমস্যা দূর করতে না পারলে সব খাতই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অটনমি প্রয়োজন। আমরা এটা নষ্ট করে ফেলেছি। এর একটা সমাধান দরকার; যা করতে হবে অতিদ্রুত।’

রুবানা হক বলেন, ‘আমাদের আর দুটি বছর সরকারের সহায়তা খুব প্রয়োজন। এজন্য নগদ সহায়তা, কর রেয়াতসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন।’ শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক কিছু করার জন্য সরকারের কাছে সহায়তা চান তিনি।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভ্যাট আইনে যে চারটি স্তর রাখা হচ্ছে তা পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। এটা এখন আর ভ্যাট আইন হবে না, হয়ে যাবে মাল্টি স্টেজ এক্সাইজ ডিউটি। এটা বাস্তবায়ন হলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এতে সাবকন্ডাক্টিং বলতে কোনো ব্যবসা আর থাকবে না। এখন পর্যন্ত এনবিআর কোনো বছরই তার টার্গেট শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারেনি।’ ফলে বাস্তবতার নিরিখে বাজেট দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর